অভিমত

প্রবাসী আয় বাড়াতে নগদ প্রণোদনার বিকল্প হতে পারে নন–ক্যাশ প্রণোদনা

মো. নুরুল আলম, এফসিএমএ, এফসিএ জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার ২০১৯ সালের পয়লা জুলাই থেকে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার নির্ধারিত বিনিময় হারের সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২০১৯ ও ২০২০ সালে বিদেশে কর্মসংস্থান কমলেও বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, অর্থ পাচার প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ২০২২ সাল থেকে প্রবাসী আয়ের বিপরীতে নগদ প্রণোদনার হার বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়। ২০২২ সালে প্রণোদনার হার ও বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়লেও ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা বাড়েনি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ক্রমেই নিম্নগামী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বৈধ পথে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে। তবে ধারণা করা হয়, প্রকৃতপক্ষে প্রবাসীরা এর কয়েক গুণ বেশি ডলারের সমমূল্যের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে থাকেন। ফলে দেশে প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ায় আমরা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। হুন্ডিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য বেশি পাওয়া যায়, সে জন্য এর মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠাতে প্রবাসীরা আগ্রহী হচ্ছেন বলে ধারণা করা যায়। সরকার প্রণোদনার হার কমিয়ে দিলে হুন্ডির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। আবার সরকার চাইলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে প্রণোদনার হার আড়াই শতাংশ থেকে আরও বাড়াতে পারে। কিন্তু তাতে সরকারের নগদ ভর্তুকি বৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াসহ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা আছে। প্রণোদনার হার অনেক বেশি বা আকর্ষণীয় হলে প্রবাসীদের কাজে লাগিয়ে এটি অপব্যবহারের ঝুঁকিও থাকে। অর্থাৎ বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও নগদ প্রণোদনার হার হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উভয়সংকট বিদ্যমান।

এই পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে নগদ প্রণোদনা আড়াই শতাংশ ঠিক রেখে অতিরিক্ত ৫-১০ শতাংশ বা আরও বেশি হারে নন-ক্যাশ প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। নন-ক্যাশ প্রণোদনা এমন হতে হবে, যাতে এর সুবিধা শুধু প্রবাসী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ভোগ করতে পারেন এবং প্রবাসীদের ব্যবহার করে কোনো চক্র এর সুবিধা না নিতে পারে। এতে প্রবাসীরা ক্যাশ ও নন-ক্যাশ—উভয়ের ধরনের প্রণোদনার আশায় কোনোভাবেই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাবেন না। নন-ক্যাশ প্রণোদনার হার এমন হতে হবে, যাতে হুন্ডি ব্যবসায়ী কিংবা যেসব ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে বৈধ উপায় বা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থ প্রেরণ করেন, তাঁরাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরুৎসাহিত হবেন। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে ডলারের বেশি দাম দিতে গিয়ে যাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, সেভাবে নন-ক্যাশ প্রণোদনার হার নির্ধারণ করতে হবে।

বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডসহ বিভিন্ন শুভেচ্ছা কার্ড বা চেইন শপের মেম্বারশিপ কার্ড বা নিবন্ধন নম্বরের বিপরীতে নগদ সুবিধার বিকল্প হিসেবে ক্রেডিট পয়েন্ট সরবরাহ করা হয়। পরবর্তীকালে গ্রাহক ওই পয়েন্টে সরাসরি নগদায়ন করতে না পারলেও নগদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারছেন।

একইভাবে বিদেশে কর্মরত সব বাংলাদেশিকে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণের বিপরীতে নন-ক্যাশ প্রণোদনা হিসেবে বিশেষ নিবন্ধন বা পরিচিতি নম্বর ও কার্ড সরবরাহ করা যেতে পারে। একজন প্রবাসী যখন নিজ নিবন্ধন বা পরিচিতি নম্বর ব্যবহার করে দেশে বৈধ পথে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাবেন, তখন উল্লেখযোগ্য হারে ক্রেডিট পয়েন্ট বা সমপরিমাণ অর্থ ওই নিবন্ধন বা পরিচিতি নম্বরের ঘরে যোগ হবে।

এই পয়েন্টের বিপরীতে সরকার নগদ প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেবে না। দেশে প্রবাসীদের নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন কাজে নগদের বিকল্প হিসেবে এই পয়েন্ট ব্যবহারের সুযোগ রাখা যেতে পারে, যেমন
১. ক্রয় করা জমি বা ফ্ল্যাট বা গাড়ি নিবন্ধনের সময় সরকারি ফি বা কর·প্রদান;
২. সম্প্রতি সরকারের চালু করা সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কিস্তি প্রদান;
৩. বিদেশের কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে বিমানের টিকিটের মূল্য পরিশোধ;
৪. সরকারি প্রকল্পে জমি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ে কিস্তি প্রদান;
৫. ভ্যাট, ট্যাক্স, আয়করসহ বিভিন্ন সরকারি ফি প্রদান ও পরিষেবা বিল পরিশোধ;
৬. নন-ক্যাশ প্রণোদনা ব্যবহারযোগ্য এরূপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে (কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত) প্রবাসীর অর্জিত ক্রেডিট পয়েন্ট ব্যবহারের সুযোগ।

উল্লিখিত সুবিধাদি ছাড়াও প্রবাসীদের ক্রেডিট পয়েন্টের ভিত্তিতে ভিআইপি, সিআইপির মতো সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ কোটা প্রবর্তন ও বৃত্তির ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। বিকল্প প্রস্তাব কার্যকর করা হলে প্রণোদনার হার বৃদ্ধি পেলেও এর বড় অংশ নন-ক্যাশ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট বছরে ভর্তুকি বাবদ সরকারের অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন হবে না। প্রবাসীরা বিভিন্ন কাজে নন-ক্যাশ প্রণোদনা তথা ক্রেডিট পয়েন্ট ব্যবহার করলে সরকারের আয়ের ওপর কিছুটা চাপ পড়লেও বিভিন্ন খাতে প্রবাসীদের লেনদেন বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিকভাবে কর ও নন-ট্যাক্স·খাতে সরকারের আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া নগদ প্রণোদনার হার বাড়লে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে ডলারের মূল্যে সরাসরি প্রভাব পড়লেও নন-ক্যাশ প্রণোদনার কারণে ডলারের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।

সার্বিকভাবে বলা যায়, নগদ প্রণোদনার পাশাপাশি নন-ক্যাশ প্রণোদনা–সংবলিত এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে মূল্যস্ফীতি বা মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা এড়িয়ে দেশে বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় আসা বাড়বে। এতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং প্রবাসীদের বিভিন্ন রকম সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে—এই আশা করাই যায়।