ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পকারখানায় শুরু হয়েছে শ্রমিক বিক্ষোভ। তাতে গাজীপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকায় কারখানা বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সমস্যায় জর্জরিত শিল্প খাত। তাতে নতুন বিনিয়োগ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থানেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা কথা জানিয়েছেন র্যানকন গ্রুপের গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোমো রউফ চৌধুরী।
বর্তমানে গাড়ি ব্যবসার মধ্যে মোটরসাইকেলের ব্যবসা স্থিতিশীল আছে। যেহেতু মোটরসাইকেলের বড় গ্রাহক বা ভোক্তাশ্রেণি মধ্যবিত্ত, তাই এই ব্যবসায় বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে মোটরসাইকেল ছাড়া দামি মোটরগাড়ির ব্যবসা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমে গেছে। আমরা এ দেশে মার্সিডিজ বেঞ্জ বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। তাই আমরা দেখছি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের গাড়ির বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে আমি মনে করি, এটা সাময়িক। কারণ, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সব শ্রেণির মানুষ কিছুটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এ কারণে ব্যয়বহুল খরচ কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাব মোটরগাড়ির বাজারে পড়েছে। তবে ধীরে ধীরে চলমান পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলে আবারও মোটরগাড়ির ব্যবসা আগের অবস্থায় ফিরবে বলে আমার বিশ্বাস। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই গাড়ির ব্যবস্থা আবার স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে।
মোটরগাড়ির পাশাপাশি আবাসন বা রিয়েল এস্টেট খাতেও আমরা একই ধরনের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত—উভয় শ্রেণিকে মাথায় রেখে ফ্ল্যাট তৈরি করে। ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেখানে বিক্রি আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু ৫–১০ কোটি বা উচ্চবিত্তের জন্য যেসব প্রকল্প, সেখানে বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আবাসন খাতে বর্তমানে বড় সমস্যা জমির উচ্চ মূল্য। এ কারণে ফ্ল্যাটের দাম নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি সহায়তায় ব্যাপকভিত্তিক আবাসন বা ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। যেখানে একসঙ্গে অনেক মানুষ বসবাসের সুযোগ পান। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রকল্প নিতে হলে ভর্তুকি মূল্যে সরকার জমির ব্যবস্থা করতে পারে। হতে পারে সেটা ঢাকার আশপাশে। সরকারের পক্ষ থেকে সাশ্রয়ী দামে জমির ব্যবস্থা করা গেলে আমরা বেসরকারি উদ্যোগে সেখানে ব্যাপকভিত্তিক আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে পারব। যেখানে ফ্ল্যাটের দাম নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে থাকবে।
আবাসন, গাড়ি, ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন খাতে আমাদের ব্যবসা রয়েছে। আবাসন ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা মনে হয় অস্বাভাবিক জমির দাম ও জমির দুষ্প্রাপ্যতাকে। আর গাড়ির ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন। এ খাতে আমরা যারা সংযোজন কারখানা বা বড় ধরনের বিনিয়োগ করি, কমপক্ষে ১০ বছরের পরিকল্পনা থেকেই তা করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারের কোনো একটি নীতির বিপরীতে বিনিয়োগ করার কয়েক বছর না যেতেই সেই নীতি আবার বদলে যায়। তাতে শিল্প ও বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নতুন নতুন শিল্প ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি ধারাবাহিকতা খুবই জরুরি। আমি মনে করি, গাড়িশিল্পে আমাদের নীতি যতটা না দেশে সংযোজনশিল্প গড়ে তোলার বিষয়ে সহায়ক, তার চেয়ে বেশি আমদানি–সহায়ক। নতুন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা—দেশে গাড়ি সংযোজন বা উৎপাদন যাতে উৎসাহিত হয়, সে ধরনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাতে নতুন করে এই শিল্প শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। একসময় ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারটি আমদানিনির্ভর ছিল। সরকারি নীতি সহায়তার ফলে এ খাতে ওয়ালটন একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। যার সুফল এ দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে। একইভাবে গাড়িশিল্পের ক্ষেত্রে নীতি সহায়তা দেওয়া হলে তার সুফলও সাধারণ মানুষ পাবে। পাশাপাশি হালকা প্রকৌশলশিল্প যাতে এ দেশে আরও বিস্তার লাভ করতে পারে, সে ব্যাপারেও নতুন সরকারের কাছ থেকে কার্যকর নীতি সহায়তার প্রত্যাশা করি আমরা।
লেখক: রোমো রউফ চৌধুরী, গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, র্যানকন গ্রুপ