২০২৫ সাল নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস বেশ মন খারাপ করবার মতো। তারা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জলবায়ুর মন্দ প্রভাব ও সংকোচনমূলক অর্থনৈতিক নীতি-এই তিন কারণ দেখিয়ে বলেছে ২০২৫ অর্থবছরে আমাদের জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ঘটবে মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু আমি আইএমএফকে বাদ দিয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবির আশাব্যঞ্জক পূর্বাভাসটাকেই বিশ্বাস করতে চাই। এডিবির হিসাবে এই প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। সেটাই হোক।
প্রবৃদ্ধি কত হবে না হবে তার প্রধান নিয়ামক হিসেবে আমি মুদ্রাস্ফীতিকে সবার সামনে নিয়ে আসতে চাই। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে এখন প্রধান প্রতিবন্ধকতা এই মুদ্রাস্ফীতি ; এবং তার লেজে লেজে মূল্যস্ফীতি। কৌশলগতভাবে এই দুই স্ফীতি একই জিনিস, আবার এক নয়। জিনিসের দাম শুধু ডলার-টাকা বিনিময় হার কমা-বাড়ার কারণে কমে-বাড়ে না।
মূল্যস্ফীতি জিনিসটা মুদ্রাস্ফীতি থেকে বৃহত্তর ও গভীরতর এক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়। বহুদিন ধরে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার কথা বলা হলেও আমরা কিন্তু সেসব চেষ্টার তেমন কোনো সুফল আজও দেখতে পাইনি। আমার মনে হয়, সঠিক সময়ে সঠিক নীতি সহায়তা বা নীতি-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে। মুদ্রাস্ফীতির অনেকগুলো চলকের মধ্যে একটা ডলার-টাকার বিনিময় হার। সেখানে আমদানি ব্যয় কমাতে গিয়ে রপ্তানি আয় কমিয়ে ফেলা কাজের কথা না। যেমন এ দেশে কাজের কথা না সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা। এটা তো আমেরিকা না যে এ দেশের সবাই ব্যাংক-গ্রাহক আর সবাই ব্যাংক ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে তাদের জীবন কাটাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সুদ হার বাড়ানো হলো তো সারা দেশের মানুষের ঋণের কিস্তি বেড়ে গেল। খরচ করবার মতো আয় কমে গেল, তখন পণ্যের চাহিদা কমতে থাকল, তাই শেষে আস্তে আস্তে জিনিসের দাম কমতে থাকল। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এল। এমনটা আমেরিকাতে হলেও বাংলাদেশে হচ্ছে না।
আমাদের মূল্যস্ফীতি কমানোর তরিকা আমাদের মতোই হতে হবে। টাকার সঠিক বিনিময় হার এখানে বড় ব্যাপার। ওটা ঠিক তো রপ্তানি ঠিক, রেমিট্যান্স ঠিক, শেয়ারবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট আসা ঠিক, বিদেশি বিনিয়োগ আসাটাও ঠিক। অর্থাৎ মুদ্রার সঠিক মূল্য এ দেশে অর্থনীতির চাকা পুরো ঘুরিয়ে দিতে পারে। আর ওই চাকা সচল তো মানুষের আয় বাড়ার সম্ভাবনাও বাস্তব। আয় বাড়লে মূল্যস্ফীতি আপনার গায়ে লাগবে না। আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে মানুষের আয় বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির বিপরীতে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তৈরি কাজের কথা হতে পারে।
সেই চাকা সচল ও বেগবান করতেই সঠিক একটা বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে যাওয়ার দিকে জোর দিচ্ছি আমরা। সঠিক মুদ্রা বিনিময় হারের অনেক ভালো প্রভাব আছে। আমরা শুধু মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভালো দিক পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি; এটা অর্থনীতির জন্য ভালো হচ্ছে না। আমার প্রত্যাশা, নতুন বছরে আমাদের নীতি নির্ধারকেরা অর্থনীতির এই মূল জায়গায় ঠিক নীতি গ্রহণ করবেন।
মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় এর পাশাপাশি সুসমন্বিত রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির হস্তক্ষেপ অবশ্যই দরকার। আমাদের ব্যাংক খাত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার বিষয় দুটোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ঋণ ঝুঁকি, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির মতো কাঠামোগত সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠাও এখন জরুরি। কারণ অনেক সময় তো পেরিয়ে গেল। ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফিরতে হবে।
পাশাপাশি নতুন বছরে আমি চাই, বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুকে সোজা-সরল ও জনবান্ধব করে দেবে। যাতে করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়টা পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাস্তব বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কথা বলতেই মনে হলো, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের ফোকাস হতে হবে উদ্ভাবন উৎসাহিত করা। অবশ্যই ভারসাম্যমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, ন্যায় ভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও তার সুফলের সুষম বণ্টন; সমতার কথা আপ্তবাক্যের মতো শোনালেও অনবরত বলে যেতেই হবে।
মাসরুর আরেফিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক,সিটি ব্যাংক