বিবিএসের তথ্য

মূল্যস্ফীতি কমলেও স্বস্তি নেই 

যে কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি 

  • জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি।

  • নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম।

  • মার্কিন ডলারের সংকট।

  • আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা।

দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের কাছাকাছি। বাজারে গিয়ে ক্রেতারা স্বস্তি না পেলেও তিন মাস ধরে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি কমছে বলে জানিয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে নেমে এসেছে। 

বিবিএসের হিসাবে, অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেই হিসাবে আগস্টের পরের তিন মাস ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমেছে। গতকাল সোমবার নভেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। 

নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মানে হলো, ২০২১ সালের নভেম্বরে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের নভেম্বর মাসে একই পণ্য কিনতে খরচ হচ্ছে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা। তার মানে এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। 

মূল্যস্ফীতির হিসাবটি ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে করা হয়েছে। এত পুরোনো ভিত্তিবছর ধরে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এ ছাড়া তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহেও দুর্বলতা আছে।
তৌফিকুল ইসলাম খান, জ্যেষ্ঠ গবেষক, সিপিডি 

বিবিএস বলছে, গত অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে আদা, ময়দা, সুজি, চিনি, ভোজ্যতেল, মসলা, ফল, পোশাক, স্বর্ণ ইত্যাদির দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি, পাম তেল, সবজি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ইত্যাদির দাম নভেম্বরে কমেছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, নভেম্বর মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অক্টোবরে এই হার ছিল সাড়ে ৮ শতাংশ। 

মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, শাকসবজির দাম কমেছে। এ ছাড়া ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে। 

গতকাল মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে পরিকল্পনামন্ত্রী। বিবিএসের হিসাবে, গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৮৫%। 

শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি 

গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। গত নভেম্বরে গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এদিকে শহরেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়েছে। সার্বিকভাবে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। গ্রামে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ, আর শহরে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।

এদিকে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে অনেকে রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তাঁদের আশা পূরণ হয়নি। মূল্যস্ফীতি কমার মূল কারণ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো পণ্যে কর ছাড় এবং টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে পণ্য বিক্রির কারণে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মূল্যস্ফীতির উত্তাপ ঠেকাতে মধ্যবিত্তের জন্য কোনো উদ্যোগ আছে কি না—জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মধ্যবিত্তের জন্য আলাদা কোনো উদ্যোগ নেই। অর্থনৈতিক, মানবিক ও রাজনৈতিক কারণে নিম্নবিত্তের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, মূল্যস্ফীতি গণনার পণ্যের তালিকা পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। ফলে ওই তালিকা থেকে অনেক পণ্য বাদ যাবে।

মূল্যস্ফীতির তথ্যের পাশাপাশি প্রতি মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির তথ্যও প্রকাশ করা হয়। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম হলে প্রকৃত আয় কমে যায়। বিবিএসের হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর মানে, একজন শ্রমিক ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ১০০ টাকা মজুরি পেলে এ বছর নভেম্বরে তার মজুরি বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা ৯৮ পয়সা। কিন্তু একই সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ যে হারে মজুরি বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। গরিব মানুষের বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণির। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি মানে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তাঁরা বাজার থেকে আগের মতো পণ্য কিনতে পারছেন না। অবশ্য কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।

সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির হিসাবটি ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে করা হয়েছে। এত পুরোনো ভিত্তিবছর ধরে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এ ছাড়া তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহেও দুর্বলতা আছে। বিবিএসের তথ্য ও টিসিবির তথ্যের মধ্যে গরমিল আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে গরিব মানুষের জন্য আলাদা করে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা প্রয়োজন। কারণ, তাদের জন্য নীতি সহায়তা নিতে গেলে পরিষ্কার চিত্র থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, গরিব মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়তি। ফলে তাদের প্রকৃত আয় কমছে। গরিব মানুষের জীবনযাত্রা খারাপ হচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই।