জাকির হোসেন
জাকির হোসেন

ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী নয়, আমরা এখন ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান

দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা অপরিসীম। সাত শর বেশি প্রতিষ্ঠান এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। ক্ষুদ্রঋণের অগ্রযাত্রা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশেষ আয়োজন। এ বিষয়ে বুরো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ার, এনজিও ফেডারেশন জাকির হোসেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতীক বর্ধন

প্রশ্ন

ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। গত ৫৩ বছরে এনজিওগুলোর ভূমিকা কীভাবে দেখছেন?

জাকির হোসেন: ৫৩ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭০ সালে দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলার আর বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। উপার্জন বরাবরই উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত আর এই উৎপাদন ও উপার্জনপ্রক্রিয়ার বিকাশে শুধু সরকার নয়, সরকারের অংশীদার হিসেবে এনজিও-এমএফআই (ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান) খাত নিভৃতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এ খাত স্বাধীনতা-পরবর্তী দরিদ্র ও হতদরিদ্র-অধ্যুষিত বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে দারিদ্র্য নিরসন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে বেশি নজর দিয়েছে। পরবর্তীকালে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও এনিজওগুলোর ভূমিকা পালন করছে। আমাদের এই খাতের মাধ্যমে সাড়ে তিন কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

প্রশ্ন

কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এনজিওগুলোর কী ভূমিকা রাখতে পারে?

জাকির হোসেন: বিগত দশকগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যে উন্নয়ন ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, ২০৩৩ সাল নাগাদ আমরা বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হব। তবে এ দুই সময়ের মধ্যবর্তী ভূরাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর প্রভাবের কথাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ কিংবা দুর্যোগ গভীরভাবে দেশীয় অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এগুলোও দায়ী। তবে আমাদের দেশীয় অব্যবস্থাপনা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের টেকসই উন্নয়নে এনজিওগুলো অনেক দিন ধরে কাজ করছে। এ খাতে নতুন আর কী কী করার আছে বলে মনে করেন।

জাকির হোসেন: আপনি ঠিকই বলেছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন ধরেই এনজিও-এমএফআইগুলো কাজ করে যাচ্ছে। তবে এ দুই খাতে আমাদের কাজগুলো প্রাথমিক ও মাঠপর্যায়ের। সম্প্রতি দু-একটি এনজিও বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ হাসপাতাল স্থাপন করে সাধারণ মানুষকে সেবা দিচ্ছে, যদিও এর ব্যাপকতা তেমন একটা নয়। সরকারি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে মান ধরে রাখতে পারেনি, আমরা তা পেরেছি। পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে এনজিও-এমএফআই খাতের অনেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ব্র্যাক, আশা, বুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস—এগুলোর সবারই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল কিংবা মেডিকেল কলেজ আছে।

প্রশ্ন

ক্ষুদ্রঋণের সেবা ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন কি?

জাকির হোসেন: বুরো বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি এনজিও-এমএফআই এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল যাত্রায় সংযুক্ত হওয়ার জন্য কাজ করছে। বুরো বাংলাদেশসহ দেশের শীর্ষ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা শাখাগুলোয় শতভাগ অটোমেশন সম্পন্ন করে পরিপূর্ণ ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বুরো বাংলাদেশ গ্রাহকদের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে ঋণ ও সঞ্চয় সেবা দেওয়া শুরু করে ২০১৯ সালে।

প্রশ্ন

আপনাদের প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষুদ্রঋণ দিয়েছে? এর কী প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন?

জাকির হোসেন: আমরা গ্রাহকদের এ পর্যন্ত ৯৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। এই ঋণের অর্থে অনেক মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই নারী, নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, কেউ উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন, কেউ তাঁর সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন, কেউ কেউ বংশানুক্রমিক পেশা সচল রেখেছেন, কেউবা ছোট ব্যবসা বড় করেছেন। পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। তাঁরা অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন এবং অনেক মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস জুগিয়েছেন। সমাজে এর প্রভাব বিপুল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি পরিসরে তাঁরা অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছেন, তার উৎসে আছে বুরো বাংলাদেশের ঋণসহায়তা।

  • জাকির হোসেন

    প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, বুরো বাংলাদেশ