আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও শুল্ক—তিন খাতেই কর অব্যাহতি কমাতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করে, কর অব্যাহতির প্রবণতা অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না।
তাই কোন কোন খাতে কর অব্যাহতি আছে, এর তালিকা চেয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি কোন কোন খাতকে কর অব্যাহতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়, তা নিয়ে পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছে এই দাতা সংস্থাটি। এ বিষয়ে প্রয়োজনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে তারা।
গতকাল রোববার সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদল এনবিআরের আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি) মাসুদ সাদিক, সদস্য (আয়কর নীতি) শামস উদ্দিন আহমেদ, সদস্য (ভ্যাট নীতি) জাকিয়া সুলতানা, সদস্য মইনুল খান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচার এনবিআর প্রধান কার্যালয়ে ওই সভাগুলো হয়। তিনটি সভা শেষে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করে আইএমএফের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল।
কর অব্যাহতি সুবিধা নিয়ে সভায় এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশীয় শিল্প বিকাশে কিছু খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা দিতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন কর অব্যাহতি সুবিধা আছে। তবে ধীরে কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনা হচ্ছে। এদিকে আইএমএফ প্রতিনিধিদল গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। এ সময় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদ থেকে আমলা পরিচালকের সংখ্যা কমাতে বলেছে আইএমএফ।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরে প্রতিটি খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন ছিল—এই অর্থনৈতিক চাপের সময়ে শুল্ক-কর আদায় বাড়বে কীভাবে? জবাবে ওই তিন খাতের কর্মকর্তারা গত তিন মাসের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, বর্তমান ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে গত অর্থবছরের চেয়ে এবারও রাজস্ব আদায়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে। এ ছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে করজাল সম্প্রসারণসহ প্রচেষ্টানির্ভর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর বাড়াতে পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি রাজস্ব খাতের সংস্কারে অটোমেশন, নতুন কাস্টমস ও আয়কর আইন প্রণয়নের তাগিদও দেওয়া হয়েছে। কোন আইন কবে চালু হবে, তা জানতে চেয়েছেন তাঁরা। জবাবে শুল্ক খাতের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাস্টমস আইনটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠানো হয়েছে। এটি কবে পাস হবে, তা আইনপ্রণেতারা ঠিক করবেন। অন্যদিকে আয়কর আইন প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলছে।
সার্বিকভাবে করভার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফের কর্মকর্তারা। শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে গড় আমদানি শুল্কভার ১৪ শতাংশের মতো। আর সার্বিকভাবে আমদানি শুল্কের গড় সংরক্ষণ হার ২৯ শতাংশের মতো। ধীরে ধীরে এই হার কমিয়ে আনা হচ্ছে।
এ ছাড়া ভ্যাট খাতের সংস্কারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। আইএমএফ-কে জানানো হয়েছে, অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দেওয়ার হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই পর্যন্ত আট হাজার ভ্যাটের মেশিন বসেছে। আরও তিন লাখ ভ্যাটের মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভ্যাট আদায় যেমন বাড়বে, তেমনি কালোটাকার দৌরাত্ম্য কমবে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে বর্তমানে আমলা ও সাবেক আমলাদের প্রাধান্য। ব্যাংকিং নিয়মনীতি, ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ে স্বাভাবিক কারণেই যাঁদের জানা-বোঝা কম। পর্ষদে আগে এ প্রাধান্য ছিল রাজনৈতিক দলের কর্মীদের, ব্যাংকিং বিষয়ে যাঁদের জানা-বোঝা আরও কম।
গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদে দক্ষ, পেশাদার ও নীতিনিষ্ঠ পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটি আপত্তি জানিয়েছে ব্যাংকগুলোর পর্ষদে, বিশেষ করে বর্তমান আমলাদের প্রাধান্য দূর করতে।
বৈঠকে সরকারের দিক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এবং আইএমএফের দিক থেকে সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ নেতৃত্ব দেন।
বৈঠক শেষে শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর বক্তব্য জানতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে গেলে তাঁর একান্ত সচিব শিহাব উদ্দিন আহমদ বলেন, সচিব তাঁকে বলেছেন যে এটা ছিল নিয়মিত একটি বৈঠক এবং বৈঠকের কোনো বিষয় নিয়ে তিনি মন্তব্য করবেন না।
অগ্রণী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদে পর্ষদের ৯ জনের মধ্যে ৩ জনই বর্তমান আমলা। তাঁরা হলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মফিজ উদ্দীন আহমেদ, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য খোকন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী।
রূপালী ব্যাংকে আছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক মো. আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব রুখসানা হাসিন এবং অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব ও অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব ফেরদৌস আলম। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে আছেন এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমান এবং জনতা ব্যাংকে আছেন চারজন সাবেক অতিরিক্ত সচিব।
সূত্রগুলো জানায়, আইএমএফ প্রতিনিধিদল আমলানির্ভর পর্ষদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পুনঃ মূলধনের প্রয়োজনীয়তাসহ আর্থিক খাতের সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমাতে কৌশলপত্র তৈরির পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। ব্যাংক কোম্পানি আইন, দেউলিয়া আইনসহ পাঁচটি আইন প্রণয়নের হালনাগাদ তথ্য জানতে চেয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়েছে, পাঁচ আইনের মধ্যে দুটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। বাকিগুলোর কাজ হচ্ছে। ব্যাংকে আমলা পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে আইএমএফের সুপারিশ বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হয়।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গেও গতকাল বৈঠক হয়েছে আইএমএফ দলের। আইএমএফ সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল প্রণয়ন এবং বছরে চারবার মুদ্রানীতি প্রকাশের কথা বলেছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক দলটিকে জানিয়েছে, বর্তমানে বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রকাশিত হলেও তা বছরে দুবার করা হবে। পর্যায়ক্রমে তা চারবার প্রকাশ করা হবে। কারণ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বর্তমানে বছরে একবার জিডিপির হিসাব প্রকাশ করে।
এই হিসাব একাধিকবার প্রকাশ করা হলে মুদ্রানীতিও বেশিবার প্রকাশ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও আমন ওঠার পর থেকে তা কমে যাবে। সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করা হবে ধীরে ধীরে।