ব্যাংক একীভূত হবে, কেউ কি শাস্তি পাবে

  • সংকটে থাকলেও বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া পদ্মা ব্যাংক

  • ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ‘সেফ এক্সিট’ পেয়েছেন

  • পদত্যাগের মাধ্যমে দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছেন তাঁর উত্তরসূরি চৌধুরী নাফিজ সরাফতও

  • ব্যাংক খাতে যে সংকট, ব্যাংক একীভূত করে কি সেই সংকট কাটানো যাবে—এটি বড় প্রশ্ন

শেষ পর্যন্ত একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিলীন হতে চলেছে। পদ্মা ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে বারবার রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তবে চূড়ান্ত বিচারে তা কাজ করেনি। অনেকটা শুরু থেকেই সংকটে থাকলেও বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এই ব্যাংক। কিছু ব্যাংক একীভূত করার যে চেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরু করেছে, তার ফলে পদ্মা ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাদের সীমাহীন অনিয়মের কারণে একটি ব্যাংকের এই অবস্থা হলো, তাদের আদৌ কোনো শাস্তি হবে কি না।

পদ্মা ব্যাংকের ইতিহাস লজ্জার। এক দশক আগে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তাদের একটি ছিল পদ্মা ব্যাংকের পূর্বসূরি ফারমার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু থেকেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তারা, অনুমোদন পাওয়ার আগেই এটি কার্যালয় খুলে লোকবল নিয়োগ দিয়েছিল। প্রভাব ছড়িয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত নিয়েছিল ব্যাংকটি, চলেছে অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে খুব দ্রুতই সংকটে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক।

প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মধ্যে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটি তখন কার্যত ধুঁকছে। চারটি সরকারি ব্যাংক ও রাষ্ট্র খাতের ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) টাকা মূলধন হিসেবে জোগান দেওয়া হয় ফারমার্স ব্যাংকে, এটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। যে ব্যাংকের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়াই ছিল যৌক্তিক উপসংহার, সেটিকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হয় রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রকের সিদ্ধান্তে। তবে ফারমার্স ব্যাংক আর্থিক খাতে এরই মধ্যে এতটাই দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে যে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এসে সেটির নাম পাল্টাতে হলো।

ফারমার্স ব্যাংক কাগজে-কলমে আর সাইনবোর্ডে পদ্মা ব্যাংক হলেও এই ব্যাংকে গুণগত কোনো পরিবর্তন যে আসেনি, তা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। পদ্মা ব্যাংক যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাঁরা আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করে নানা রকম ছাড় নিতে শুরু করেন। বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, এমন মুলা ঝুলিয়ে এসব সুবিধা আদায় করে ব্যাংকটি। কিন্তু প্রতিশ্রুত সেই বিনিয়োগ কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে পদ্মা আরও শুকিয়েছে। আর আস্থা হারিয়েছেন আমানতকারীরা।

নিজেদের ওয়েবসাইটে পদ্মা ব্যাংক বেশ অহংকার করেই বলেছে, গ্রাহকদের ‘আর্থিক সম্পদের বিশ্বস্ত অভিভাবক’ হতে চায় তারা। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষে এই ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু ব্যাংকটির দেওয়া ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণের ৬২ শতাংশই খেলাপি। আয় দিয়ে আর আমানতের সুদ পরিশোধ করতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। সুতরাং ‘বিশ্বস্ত অভিভাবকের’ দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। শেষ পর্যন্ত বড় আমানত শেয়ারে রূপান্তরের চেষ্টা চালিয়েছিল পদ্মা, কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পায়নি।

মহীউদ্দীন খান আলমগীরের প্রস্থানের পর পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ার এখন চার সরকারি ব্যাংক ও আইসিবির হাতে। চরম সংকটে থাকা ব্যাংকটিতে ২০১৮ সালে ৭১৫ কোটি টাকা ঢেলেছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে ব্যাংকটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করতেন কিছুদিন আগে পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফত। সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই ব্যবসায়ীর সময়ে পদ্মা ব্যাংকের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
বাংলাদেশে ব্যাংকের পতন বিরল ঘটনা। কিন্তু পশ্চিমা আর্থিক জগতে এটা অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। ২০০০ সাল থেকে সেখানে ৫৬৮টি ব্যাংকের পতন ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ২৫টি ব্যাংক তাদের কার্যক্রম গোটাতে বাধ্য হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের পতন হয়েছে ২০১০ সালে, ১৫৭টি। ২০০৯ সালে ছিল ১৪০টি। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া আর্থিক সংকট ছিল এর কারণ, যা পুরো পৃথিবীর আর্থিক খাতকে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এরপর আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে শুরু করে।

কিন্তু রাশ আলাগা হলে যে আবার বিপদ আসতে পারে, তা দেখা গেছে গত বছর। যুক্তরাষ্ট্রে বছরের প্রথম দিকে একে একে চারটি ব্যাংক ধসে পড়ে। বছরের শেষের দিকে আরেকটি। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ধসে পড়ার কারণ সম্পর্কে ওই বছরের এপ্রিল মাসে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করে। তাতে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনাকে যেমন দায়ী করা হয়, তেমনিভাবে দায়ী করা হয় ফেডের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তাদের, যাঁরা ব্যাংকটির ‘দুর্বলতা’ উপলব্ধি করতে পারেননি। ওই প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে ফেডের ‘নিয়ন্ত্রণমূলক মানে পরিবর্তন’ আনাকেও দায়ী করা হয়, অর্থাৎ আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণে যে শিথিলতা ছিল, সেই বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে ব্যর্থতার দায় কেউ স্বীকার করে না। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকেরাও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এই ব্যর্থতা পুরো আর্থিক খাতকেই এখন বিপদে ফেলেছে। বেশ কিছু ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক হিসেবে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়েছে। এমন ব্যাংকের সংখ্যা ১৫টি বা দেশে চালু মোট ব্যাংকের এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু এরপরও বিশেষ তদারকিতে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

দুর্বল ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে না কেন, তা সম্ভবত ধরতে পেরেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী। কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, এসব ব্যাংকের মালিক ও বড় গ্রাহকদের বেশির ভাগ সরকারঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটা বড় প্রশ্ন।
পদ্মা ও এক্সিম একীভূত হচ্ছে স্বেচ্ছায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি বছর স্বেচ্ছায় ব্যাংক একীভূত না হলে চাপ প্রয়োগ করা হবে। কর্তৃপক্ষ কোন কোন ব্যাংককে একীভূত করতে চায়, সেটি প্রকাশ করা হয়নি। তবে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ১০টি পর্যন্ত ব্যাংক একীভূত হতে পারে। এই সংখ্যা মোট ব্যাংকের ছয় ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ বেশ বড়সংখ্যক ব্যাংকের পরিস্থিতি যে ভালো নেই, এটি তার একরকমের স্বীকারোক্তি।

কিন্তু ব্যাংক খাতে যে সংকট, ব্যাংক একীভূত করে কি সেই সংকট কাটানো যাবে—এটি একটি বড় প্রশ্ন। এই সংকটের জন্য যারা দায়ী—তা মালিক পক্ষ হোক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, তাদের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে, সেটি আরেকটি বড় প্রশ্ন। ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই এখন দাবি উঠেছে, তাঁরা ‘লুণ্ঠিত ঋণের’ দায় নিতে চান না। এ দেশে আমানতকারীদের অর্থ যাঁরা লুণ্ঠন করেছেন বা লুণ্ঠনে সহায়তা করছেন, তাঁদের কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয় না। ব্যাংক একীভূত হয়ে আরও বড় যে ব্যাংক হবে, সেখানে লুটপাট বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটা জানাও এখন জরুরি।

কোনো জবাবদিহি করা ছাড়া ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে পদত্যাগ করার সুযোগ দিয়ে ‘সেফ এক্সিট’ দেওয়া হয়েছিল। পদত্যাগ করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁর উত্তরসূরি পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফতও। তাই বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি আর অনিয়মের একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়েই থাকবে পদ্মা ব্যাংক।