আশিক চৌধুরী
আশিক চৌধুরী

আগামী বছরের শুরুতে নতুন বিনিয়োগে উন্নতি দেখা যাবে

পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের বিনিয়োগবিষয়ক শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্বে এসেছেন আশিক চৌধুরী। স্কাই ডাইভিংয়ে বিশ্ব রেকর্ড করা আশিক চৌধুরী এর আগে সিঙ্গাপুরে বহুজাতিক এইচএসবিসি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রথম আলোকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

প্রশ্ন

বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক থেকে সরাসরি দেশের বিনিয়োগবিষয়ক শীর্ষ দুই সংস্থার দায়িত্ব পেয়েছেন। নতুন জায়গা কেমন মনে হচ্ছে?

আশিক চৌধুরী: আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি যে এখন দেশের সেবা করতে পারব। আমার বর্তমান অবস্থান দেশের প্রধান বিপণন কর্মকর্তার। সুতরাং লক্ষ্য খুব পরিষ্কার, দেশের বিনিয়োগ ইকোসিস্টেমের (পরিস্থিতির) উন্নতি করতে হবে। বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা দেশের দূত হিসেবে কাজ করবেন; নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন। প্রথম কাজ হিসেবে তাই বিদ্যমান ও সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলছি। তাঁদের অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা হবে।

প্রশ্ন

এই সময়ে আপনি কী করতে পারবেন বলে আশা করেন?

আশিক চৌধুরী: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসেছে। এই সময়ে কোন বিষয়গুলো সংস্কার করা হলে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে উপকারী হবে, তা নিয়ে কাজ করছি। তাঁদের কোন সমস্যা কত দিনের মধ্যে সমাধান করা যাবে, সেটিও স্পষ্ট করে জানানো হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য কিছু পথনির্দেশনাও ঠিক করে দিতে পারব বলে আশা করছি।

আশিক চৌধুরী
প্রশ্ন

দেশে দীর্ঘদিন ধরে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ কম। এমন পরিস্থিতিতে বিডা-বেজা কীভাবে তাদের কাজ এগিয়ে নেবে?

আশিক চৌধুরী: দেশে বিনিয়োগবিষয়ক অনেকগুলো সংস্থা থাকায় বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। আমরা বিশ্বাস করি, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ভালো অভিজ্ঞতা দিতে পারলে তাঁরাই আমাদের দূত হয়ে কাজ করবেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন আগামী নভেম্বর মাস থেকে বেজা ও বিডায় পুরোপুরি ডি-নথি (ডিজিটাল নথি) পদ্ধতি চালু হবে। প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়াতে বেসরকারি খাত থেকে কিছু অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে যুক্ত করার চিন্তা আছে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়েও ভাবছি। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করতে হয় এবং কী সেবা দিলে তাঁরা সন্তুষ্ট হবেন, এ বিষয়ে বিডা ও বেজার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া নিয়ে কাজ করছি। সেবার দিক থেকে আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা দেশের সবচেয়ে সেরা সরকারি সংস্থা হতে চাই।

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ জানান। এক. দুর্নীতি। দুই. সেবা প্রদানে বিলম্ব হওয়া। এই দুটি বিষয় একই সঙ্গে সামলাতে ডিজিটালাইজেশনের চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই
আশিক চৌধুরী, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিডা ও বেজা।
প্রশ্ন

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কোথায় পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন?

আশিক চৌধুরী: বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের খুবই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটা ব্যবসা শুরু করতে কতগুলো পৃথক জায়গা থেকে নিবন্ধন নেওয়া লাগে, সেটি বিবেচনা করলেই তা বোঝা যায়। এসব কারণে আমরা প্রচুর বিনিয়োগ আগ্রহ পেলেও প্রকৃত বিনিয়োগ পাই না। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ জানান। এক. দুর্নীতি। দুই. সেবা প্রদানে বিলম্ব হওয়া। এই দুটি বিষয় একই সঙ্গে সামলাতে ডিজিটালাইজেশনের চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠান ডিজিটালাইজড করলে দুর্নীতি কমবে এবং সেবার মান ও গতি বাড়বে।

আশিক চৌধুরী
প্রশ্ন

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাইরের মানুষ বাংলাদেশকে কীভাবে দেখেন?

আশিক চৌধুরী: দেশের জনসংখ্যা, তরুণ জনগোষ্ঠী, স্থানীয় বাজার, অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি মৌলিক জায়গায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। দেশের বাইরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কাছাকাছি অবস্থানে থাকলেও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনামকে বেশি প্রাধান্য দেন। এর একটি কারণ হতে পারে, আমরা বাংলাদেশের গল্পটা বহির্বিশ্বের কাছে ভালোভাবে প্রচার করতে পারিনি। অর্থাৎ আমাদের কাজের পদ্ধতিতে ঘাটতি রয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিনিয়োগকারীদের আমরা যে অভিজ্ঞতা দিয়েছি, সেটি বেঞ্চমার্ক বা কেস স্টাডি হিসেবে কাজ করে। এটির ওপর নির্ভর করেই নতুন বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেন। এই মৌলিক জায়গায় আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে।

প্রশ্ন

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিরোধের কারণে চীন থেকে অনেক শিল্প ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। জাপানি বিনিয়োগও প্রত্যাশিত মাত্রায় হচ্ছে না। এ বিষয়ে কী ভাবছেন?

আশিক চৌধুরী: এ দুটি দেশ থেকে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। অনেক কোম্পানি ভিয়েতনাম ছাড়াও বিকল্প জায়গা খুঁজছে। আমরা সেটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারি। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট কিছু শিল্পকে লক্ষ্য করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো।

প্রশ্ন

অনেক সময় বলা হয় বিনিয়োগে বড় বাধা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আপনি তো আমলা নন। আপনি বিষয়গুলো কীভাবে দেখবেন?

আশিক চৌধুরী: আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পৃথিবীর সবখানেই আছে। তবে যেসব আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা ধাপ বিনিয়োগে অহেতুক জটিলতা তৈরি করে, সেগুলো বাদ দেওয়ার চিন্তা রয়েছে। সেবাদানের সময় কমিয়ে আনার জন্য ইতিমধ্যে অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন বিডা ও বেজায় একটি কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) পদ্ধতি থাকলেও তা ব্যবহার হয় না। সেটাকে সক্রিয় করা হচ্ছে, যাতে ঠিক সময়ে সেবা প্রদান নিশ্চিত করা যায়। সরকারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের আলাদা এক দরজায় সেবা (ওএসএস) রয়েছে। এগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জায়গায় কথা বলছি।

আশিক চৌধুরী
প্রশ্ন

আগের সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। অনেকেই সেটিকে বাস্তবায়ন অযোগ্য ও রাজনৈতিক ঘোষণা বলে মনে করেন। দেশে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটিও সফল অর্থনৈতিক অঞ্চল নেই। এখনো আমরা ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আলাপে স্থির থাকব কি না?

আশিক চৌধুরী: আমি মনে করি, কতগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) হচ্ছে, সেটি বিনিয়োগকারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সব সুবিধাসহ সফলভাবে পাঁচটি ইজেড করা গেলে সেটিই যথেষ্ট হবে। আগামী ১৫ বছরের জন্য এমন একটা রোডম্যাপ (পথনকশা) দিতে চাই। যেখানে বলা থাকবে, কয়টা অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন হবে। সংখ্যাটা ১০০ না-ও হতে পারে। চাহিদা অনুসারে পরে ইজেডের সংখ্যা বাড়বে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কয়েকটি ইজেডের কাজ দ্রুত শেষ করে সেগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা। কোন অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ কত সময়ের মধ্যে শেষ হবে, সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে বিনিয়োগকারীদের বলা হবে। যাঁরা ইতিমধ্যে জমি নিয়েছেন, তাঁদের পরিষেবাসহ অন্যান্য সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে।

প্রশ্ন

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কী বার্তা দিচ্ছেন? আপনারাই বা তাঁদের উদ্বেগ নিরসনে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন?

আশিক চৌধুরী: এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে। তাঁরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রচুর অপতথ্য ও ভুল তথ্য রয়েছে। এ জন্য তাঁরা আমাদের কাছ থেকে আরও সঠিক ও হালনাগাদ তথ্য জানতে চান। আমরাও এ বিষয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। এ জন্য দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত ও সক্রিয় যোগাযোগ রাখছি।

এ ছাড়া আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো কোন দিকে যাচ্ছে, সরকার বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানাতে সব অংশীজনকে নিয়ে এখন থেকে প্রতি মাসে ‘স্টেট অব ইনভেস্টমেন্ট ইকোসিস্টেম’ নামে একটা ওয়েবিনার করা হবে। অর্থাৎ আমরা তথ্যের প্রবাহ ও আলোচনার পরিবেশটা তৈরি করতে চাই। এসব কাজ করা গেলে আশা করছি, আগামী বছরের শুরু থেকে নতুন বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যাবে।