নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ব্যবসা–বাণিজ্য ও অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির স্বার্থে এ মুহূর্তে সবার আগে দরকার দেশের মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। দেশে বেশ কয়েক দিন ধরে পুলিশের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। পুলিশের উপস্থিতিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সড়কে ট্রাফিকের কাজ করছে, বাজার তদারকি করছে। শিক্ষার্থীদের এই ত্যাগ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশ আশাবাদী করছে।
বাংলাদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা-ব্যবসার খরচ বা কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস। ঘুষ থেকে শুরু করে চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এই খরচকে বাড়িয়ে দিত। তাতে পণ্যমূল্যও বেড়ে যেত। যার ভুক্তভোগী হতেন সাধারণ মানুষ। আশা করছি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারি সেবা ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের বাড়তি কোনো খরচ করতে হবে না।
সেটি না হলেই পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। দামও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বা যেকোনো সরকারি সেবার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুব জরুরি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া এ দুটি বিষয় নতুন সরকার নিশ্চিত করবে বলে আমরা আশা রাখি। এ ক্ষেত্রে খুব শক্ত হাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিকভাবে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গেলে সেবাগ্রহীতা নিজেকেই আসামি বা অপরাধী মনে করতেন। প্রাপ্য কোনো সেবা ঘুষ বা ভোগান্তি ছাড়া পাওয়া সহজ ছিল না। আমরা এই পরিবেশের পরিবর্তন দেখতে চায়। সরকারি সব সেবা ঘুষ,দুর্নীতি ও ভোগান্তি মুক্ত করতে হবে। যদি সেটা করা না যায়, তাহলে বহু শিক্ষার্থীর রক্তে অর্জিত এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। যারা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংক মানুষের আস্থার জায়গা, এ খাতে স্বচ্ছতা আনা খুব জরুরি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আমরা কী ধরনের পরিবর্তন আনছি, সেদিকে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে। তারা এই সুযোগকে কাজে লাগানোর প্রত্যাশায় রয়েছে।
এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি, যাঁদের পাঠানো অর্থে আমাদের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী হয়, তাঁদের বিষয়েও বর্তমান সরকারকে সংবেদনশীল হতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি, প্রবাসে কষ্ট করে যেসব প্রবাসী এ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। বিমানবন্দরে তারা নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হন। তাই প্রবাসীদের সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। বৈধ পথে যাতে তাঁরা অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত হন, সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি।
সব শেষে আমি বলব বিনিয়োগের কথা। এ দেশের তরুণদের মেধা পাচার রোধ করতে হলে শোভন কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে।
এ জন্য দরকার বিনিয়োগ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। শিল্পোদ্যোক্তারা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, কর দিয়ে সরকারের রাজস্বের জোগান দেন। অথচ যখনই শিল্পের প্রয়োজনে গ্যাস-বিদ্যুৎ নানা সেবা নিতে যান, তখনই তাদের নানা ধরনের হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাগুলো বিলোপ করতে হবে। নতুন সরকার ও নতুন যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
তপন চৌধুরী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস