দেশে চলমান ডলার-সংকটের মধ্যে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে হুন্ডি বেড়ে যাওয়া নিয়ে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সম্প্রতি বলেছে, বিকাশ-নগদ ও রকেটের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। তাদের মাধ্যমে চার মাসে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বিতরণ হয়েছে। এভাবে দেশ বছরে প্রায় ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান ডলার-সংকটের জন্য কি হুন্ডিই দায়ী? আর যুগ যুগ ধরে চলা এই প্রথা বন্ধ হবে কীভাবে? বাস্তবতা হলো, ‘হুন্ডি কারবারিরা’ আগে বাসাবাড়িতে গিয়ে গিয়ে নগদ টাকা পৌঁছে দিত। এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা গ্রাহকের এমএফএস হিসাবের মাধ্যমে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা হিসাব ব্যবহার করেও হুন্ডির টাকা লেনদেন হয় বলে জোর অভিযোগ আছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, হুন্ডি তো এমনি এমনি হয় না। হুন্ডি হলো একটা উপসর্গ বা উপায় বিশেষ। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার প্রমাণ হলো এই হুন্ডি, অর্থাৎ ডিজিটাল হুন্ডি।
হুন্ডি তখনই সংঘটিত হয়, যখন কেউ দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে বিদেশে অর্থ পাঠাতে চায়, আর বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠাতে চায়, তা হাতে হাতে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠাতে চায়, তা বিদেশেই থেকে যায়। সেই অর্থ পাচারকারীদের হাতে বিদেশে তুলে দেওয়া হয়। আর দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করে, তারা তা হুন্ডি চক্রের হাতে তুলে দেয়।
দেশ থেকে অনেকেই বিদেশে নগদ ডলার নিয়ে গেলেও কেউ বস্তায় ভরে বিদেশে টাকা নিয়ে যান না। কারণ, বিদেশে বাংলাদেশি টাকার কোনো মূল্য নেই। যখন কারও বিদেশে অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন শুধু ওই অর্থের মূল্য বিদেশে স্থানান্তর হয়। দেশীয় টাকার বিপরীতে বিদেশে ডলার পেয়ে যায় পাচারকারীরা। অবৈধ এই স্থানান্তরের ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ডলারের দাম কত হলো তা বিবেচনায় রাখা হয় না।
ডলার যদি বৈধ পথে আসত তাহলে দেশের ব্যাংকগুলো ডলার পেত। তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও যুক্ত হতো। এরপর আমদানির ক্ষেত্রে সেই ডলার খরচ করা যেত। এখন যে সংকট চলছে সেটিও এতটা প্রকট হতো না। রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাসীদের পরিবার পেলেও দেশে প্রকৃতপক্ষে ডলার আসছে না। বরং উল্টো পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থ।
হুন্ডি সমস্যা মোকাবিলায় সিআইডিকে খুঁজে বের করতে হবে, কারা এসব এমএফএস এজেন্টদের টাকা দিয়েছে। তাদের থামাতে পারলেই বন্ধ হবে হুন্ডি। তারাই মূলত অর্থ পাচারকারী। না হলে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ বছরে ৭৫ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১ লাখ কোটিতে উঠেবে। পাচারও বন্ধ হবে না, হুন্ডিও চলবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ২০২০ সালের নভেম্বরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা।
গোপনে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’
সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এ ছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি তত নয়।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা-ই বলুন না কেন, অর্থ পাচারে এখন আর কেউ পিছিয়ে নেই। আর টাকার ধর্মই হলো উড়বে, নিরাপদ গন্তব্যে ছুটবে। সেটা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলাসহ যে পেশারই মানুষ হোক না কেন, অনেকেই এমন কাজ করবেন। একসময় মনে করা হতো, অবৈধ অর্থ বৈধ করতেই অর্থ পাচার করা হয়। এখন সেই ধারণাও পাল্টে গেছে।
অর্থ পাচার রোধ নিয়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট ছিল প্রবাসী আয়ের বড় উৎস। ফলে অর্থ পাচারকারীদের বড় অংশ হলেন ওই অঞ্চলের নাগরিকেরা। কারণ, ওখানকার নতুন প্রজন্মও বিদেশে আবাস গড়ছে। তারা দেশের সম্পদ বিক্রি করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আবার ধানমন্ডি ও গুলশানের মতো এলাকার অনেক বাসিন্দাও বাড়ি ও সম্পদ বিক্রি করে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। বিদেশে বৈধভাবে টাকা নেওয়ার সুযোগ না থাকায় অবৈধভাবেই তা বাইরে নেওয়া হচ্ছে। বাড়ি বিক্রির টাকা দেশে হুন্ডি কারবারিদের দিয়ে তাদের বিদেশি অংশীদারদের কাছ থেকে তা বিদেশে গ্রহণ করা হয়।
যে মাধ্যমেই টাকা পাচার হোক না কেন, ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া এসব টাকা লেনদেন হয় না। কারণ, গুলশান বা বনানীর একেকটি বাড়ি কয়েক কোটি টাকায় বেচাকেনা হয়। এত টাকা নিশ্চয়ই নগদে লেনদেন হয় না। ব্যাংকের মালিকানায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছে টাকা পাচার সহজ বিষয়। আর ব্যাংকের ঋণের টাকা যে পাচার হয়ে যাচ্ছে, এটাও নতুন নয়। সুতরাং ব্যাংক খাতে যার নিয়ন্ত্রণ যত বেশি, সে তত বড় পাচারকারী অথবা সহায়তাকারী হয়ে উঠতে পারে। আর এখন তো বিদেশে ডলার সংগ্রহের জন্য রীতিমতো রেমিট্যান্স হাউস কিনে ফেলার ঘটনাও শোনা যাচ্ছে। এসব রেমিট্যান্স হাউস যেসব প্রবাসী আয় সংগ্রহ করছে, সেই ডলার দেশে আসছে না। তাদের পক্ষে দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা বিতরণ করা হচ্ছে।
এদিকে বিদেশে ব্যাংকমালিকদের সম্পদও দিনে দিনে বাড়ছে। সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে বিনিয়োগ; মালয়েশিয়ায় বড় স্থাপনা নির্মাণ এবং ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বিলাসবহুল বাড়ি কেনার খবর এখন অনেকেই জানেন। এভাবে যাঁরা বিদেশে ধনসম্পদ গড়ে তুলেছেন, তাঁদের অনেকে সেটা নিয়ে সমাজে গর্ব করে থাকেন।
দেশে যে ঘুষ-দুর্নীতি এবং আর্থিক খাতে অনিয়ম ও লুটপাট বেড়েছে, এটা এখন সর্বজনবিদিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিভিন্ন সেবা পেতে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে দেশে ঘুষের টাকা লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি। মোট ১৭টি সেবা খাতে এই ঘুষের টাকা দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এ সময় দেশে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত ছিল পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো। দেশে মাথাপিছু ঘুষ দেওয়ার পরিমাণ ৬৭১ টাকা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকার মতো।
এসব দেখে মনে হচ্ছে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা’। যা-ই হোক, এসব অনিয়ম ও অর্থ পাচার ঠেকাতে সব ধরনের লেনদেনের ওপর নিবিড় তদারকি জোরদার করতে হবে। অর্থ পাচার রোধে কাজ করা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সংস্থাটিকেও ওপরের চাপ আর নির্দেশের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে দেশের উপকারে আসে, এমন পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, অর্থ পাচার ঠেকানোর মূল দায়িত্ব তাদের। তাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান ডলার-সংকটের পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট আয়ের সব খাতের মানুষ চাপে পড়েছে।
এ ছাড়া সক্রিয় হতে হবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থাগুলোকে। দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। তাহলেই হুন্ডি কার্যক্রম ও অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি আসলেই হুন্ডি বন্ধ করতে ও অর্থ পাচারকারীদের ধরতে চায়? আমার কিন্তু সে রকম মনে হয় না। টাকা পাচার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপেই এমন ইঙ্গিত মিলেছে। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৮ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, বিদেশে পাচার করা টাকা এখন থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফেরত আনা যাবে। এতে কেউ প্রশ্ন করবে না। কিন্তু গতকাল রোববার পর্যন্ত কেউ এভাবে দেশে অর্থ ফেরত এনেছেন বলে কোনা খবর পাওয়া যায়নি। ফলে এই সময়ে দেশে কোনো ডলার আসেনি। তাহলে কী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুবিধা দিয়ে অর্থ পাচারকেই স্বীকৃতি দিল এনবিআর?
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো
shanaullah.sakib@prothomalo.com