কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রভাব রপ্তানিসহ সামগ্রিকভাবে দেশের প্রবৃদ্ধিতে অনুভূত হবে। দেশের রপ্তানি আয়ের মূল খাত তৈরি পোশাক। ফলে এই খাতে কতটা প্রভাব পড়ল, রপ্তানি আয় তার ওপর অনেকটা নির্ভর করবে।
এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খেয়াল করতে হবে—এই যে মাঝে কয়েক দিন সহিংসতা হলো ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকল, এর মধ্যে উৎপাদন করা গেছে কি না। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে ওই কয়েক দিন ক্রেতারা কী করেছেন; তাঁরা কি অন্য কোনো দেশে ক্রয়াদেশ দিয়েছেন? নাকি তাঁরা পণ্যের দাম কম দেওয়ার জন্য দর-কষাকষি করছেন।
তবে শক্তির দিক হলো, তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের উৎপাদন ও সরবরাহ কাঠামো শক্তিশালী। অন্য কোনো দেশের সেই সক্ষমতা নেই বললেই চলে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদন করছে। অনেক দেশের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে অনেক বেশি উৎপাদন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। এই সরবরাহ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ওপর ক্রেতাদের আস্থা আছে। ফলে আমি মনে করি না মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশের তেমন কোনো সমস্যা হবে। সমস্যা যা হয়েছিল, ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তা কাটিয়ে ওঠা যাবে।
মূল সমস্যা হলো ভাবমূর্তি। এই যে রাস্তায় রাস্তায় সহিংসতা হলো এবং যেভাবে তা মোকাবিলা করা হলো ও ব্যবসা-বাণিজ্যে তার যে প্রভাব পড়ল, এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, পারসেপশন বা ধারণা। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভুল বা শুদ্ধ উভয়ই হতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যদি উপলব্ধি হয় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না, তাহলে তাঁরা বিনিয়োগ করবেন না।
উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বন্দুক-সন্ত্রাস হয় সে দেশে। প্রায়ই বন্দুকের গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হয় সে দেশে। এত বন্দুক-সন্ত্রাস সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করা নিরাপদ। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে যা হলো বা আমরা যেভাবে বিশ্ববাসীর কাছে চিত্রিত হলাম, তা মোটেও ভালো হলো না। এমনিতেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নেই—এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। এর সঙ্গে এবার নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেখলেন, এই দেশে এক টানা এত দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকে। সেই সঙ্গে এত দিন ধরে অস্থিরতা চললে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়ে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এই সংকট যথাযথভাবে মোকাবিলা করা না হলে মধ্য মেয়াদে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) প্রভাব পড়বে।
এর মধ্যে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। মূলত বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় তারা এই অবনমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা আরও বলেছে, কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনের ফলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাওয়ায় দেশের রিজার্ভে প্রভাব পড়তে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে সেই দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দেখে থাকেন। রিজার্ভ কম থাকলে তাঁরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না।
বিশ্বের সবখানেই দেখা যায়, এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলে ভোক্তার আত্মবিশ্বাসে প্রভাব পড়ে। তখন মানুষ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাবধানী হয়; প্রভাব পড়ে বাজারে। বিষয়টিও আমাদের এখন মোকাবিলা করতে হবে।
এদিকে ডলারের বিনিময় মূল্য আবার বাড়তে শুরু করেছে। ডলারের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রেখেছে। বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার; মূল্যস্ফীতির রাশ টানাই যার লক্ষ্য। কিন্তু এতে বিনিয়োগে প্রভাব পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম। তার মধ্যে ডলারের দামের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে এখন ভালো সময় যাচ্ছে না। এতে প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়তে পারে।
আব্দুর রাজ্জাক
চেয়ারম্যান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)