ঢাকার উপকণ্ঠে পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে চলছে মাসব্যাপী ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা–২০২৪। মেলায় নিজেদের অংশগ্রহণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ দেশের আসবাব খাতের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্নিচার উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নাভানা ফার্নিচারের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ইয়ামিন রিখু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারিকুর রহমান খান।
এবারের বাণিজ্য মেলায় নাভানা ফার্নিচার নতুন কী কী পণ্য নিয়ে এসেছে?
ইয়ামিন রিখু: নাভানা ফার্নিচার সব সময় বাণিজ্য মেলায় নতুন পণ্যের প্রদর্শনী করে। আমাদের হোম ফার্নিচারের প্রধান যে তিনটি ক্যাটাগরি লিভিংরুম, বেডরুম ও ডাইনিংরুম—মেলায় এই তিন ক্যাটাগরির একাধিক নতুন পণ্য আনা হয়েছে। এবারের মেলায় তিনটি নতুন ডাইনিং, তিনটি নতুন বেডরুম সেট, চারটি সোফা সেটের পাশাপাশি অনেক মাল্টিফাংশনাল ফার্নিচার আনা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরে মানুষের বসবাসের জায়গার পরিমাণ কমে আসছে। বিষয়টি চিন্তা করেই আমরা মাল্টিফাংশনাল ফার্নিচার সংযোজন করেছি। এগুলো নানাভাবেই ব্যবহার করা যায়।
নাভানার কোন ধরনের আসবাবের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ ও সাড়া বেশি? মেলা উপলক্ষে ক্রেতাদের কী কী অফার বা সুবিধা দিচ্ছেন?
ইয়ামিন রিখু: নাভানা ফার্নিচারের প্রদর্শিত সব পণ্যের প্রতিই ক্রেতাদের আগ্রহ আছে। এ ছাড়া মেলায় ক্রেতারা অফারের মাধ্যমে আসবাব কিনতে চান। সেগুলোর প্রদর্শনী না থাকলেও ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া মেলায় মূল্যছাড়ের কারণে ক্রেতারা ফার্নিচার কিনে থাকেন। মেলা উপলক্ষে নাভানা ছাড়ের পাশাপাশি ফ্রি হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। মেলায় আমরা সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দিচ্ছি।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভিড়ে মানুষ কী কী বৈশিষ্ট্যের কারণে নাভানার আসবাব পছন্দ করবেন?
ইয়ামিন রিখু: নাভানা ফার্নিচারের ডিজাইনগুলো ইউনিক। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের ডিজাইন মেলে না। নাভানার নিজস্ব আর্কিটেক্ট ও ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত ডিজাইন ও আরঅ্যান্ডডি টিম আছে। এই বৈচিত্র্যময় ডিজাইন হচ্ছে নাভানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। নাভানা ফার্নিচারের প্রতিটি স্তরে মান নিয়ন্ত্রণ এবং গুণগত মান নিশ্চিত করার কারণে আসবাব অনেক টেকসই হয়। এ দুটি কারণেই অন্যান্য ব্র্যান্ডের চেয়ে নাভানার আসবাবের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি।
নাভানা ফার্নিচারের শুরুটা কখন, কীভাবে?
ইয়ামিন রিখু: নাভানা দীর্ঘদিন থেকে আবাসন ব্যবসায় থাকার কারণে আবাসন ক্রেতাদের মধ্যে আসবাবের চাহিদা ছিল। অনেক আগে থেকেই ফার্নিচার ব্যবসা শুরু হলেও নাভানা ফার্নিচার নামে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০২ সালে যাত্রা শুরু হয়। বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানুষকে সাধ্যের মধ্যে সুন্দর আসবাব দেওয়ার লক্ষ্য তো ছিলই, এর পাশাপাশি আমদানিনির্ভর আসবাবের বিকল্প হিসেবে নাভানা ফার্নিচারের যাত্রা শুরু হয়।
বর্তমানে নাভানার পণ্যতালিকায় কত ধরনের আসবাব আছে?
ইয়ামিন রিখু: বেডরুম, লিভিংরুম ও ডাইনিংরুম—এই তিন প্রধান ক্যাটাগরি ছাড়াও অসংখ্য ক্যাটাগরির পণ্য আমাদের আছে, যেমন হাসপাতালের ফার্নিচার, ল্যাব ফার্নিচার, ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও অফিস আসবাবের বিভিন্ন চেয়ার, টেবিলসহ সব ধরনের ফার্নিচার নিয়েই নাভানা কাজ করে।
যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে নাভানা ফার্নিচার যাত্রা শুরু করেছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে?
ইয়ামিন রিখু: মোটামুটি পুরোটাই পূরণ হয়েছে; দেশব্যাপী আমাদের বিক্রয়কেন্দ্র আছে। অনলাইনে গ্রাহকেরা দেশ–বিদেশের যেকোনো জায়গা থেকে ফার্নিচারের অর্ডার করতে পারছেন। সারা দেশেই আমরা ডেলিভারি দিচ্ছি। দীর্ঘ ২২ বছরে আমাদের যে ক্রেতা শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তাঁরা নাভানার আসবাব ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন। বাংলাদেশে যে করপোরেট হাউস আছে, সেখানে যে আমদানিনির্ভর ফার্নিচার ছিল, তার বিকল্প নাভানা ও অন্যান্য ব্র্যান্ডের ফার্নিচার দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে অন্দরসাজে একধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। নাভানা সেই পরিবর্তনের ধারা কতটা গ্রহণ করেছে? আসবাব নকশার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আপনারা গুরুত্ব দেন?
ইয়ামিন রিখু: নাভানা সব সময় পরিবর্তন ও নতুনত্বকে গুরুত্ব দেয়। তাই বলা যায়, নাভানা অন্দরসজ্জার পরিবর্তনেও নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা এবার বাণিজ্য মেলায় যে পণ্যগুলো দিয়েছি, সেগুলো সম্পূর্ণ ইউরোপীয় স্টাইলের, যেগুলো আগে আমদানিনির্ভর ছিল।
দেশের আসবাব খাতের বর্তমান অবস্থা কেমন বলে মনে করেন? চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো কী?
ইয়ামিন রিখু: করোনা মহামারিসহ পরবর্তীকালের অর্থনৈতিক মন্দার চ্যালেঞ্জ, দেশের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ইত্যাদি শেষে এখন আসবাব খাতে একটু সুবাতাস বইছে। বিক্রি বাড়ছে। এই বিক্রি ধারাবাহিকভাবে আরও বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। আর চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে, আসবাবের যে কাঁচামাল সেগুলো আমদানিনির্ভর, যার ওপর শুল্ক অনেক বেশি। তাই আমদানিনির্ভরতা কমানোই এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ।
আসবাব খাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
ইয়ামিন রিখু: আসবাব খাতে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আসবাব উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ হতে শুরু করে নানাভাবে কাজের সুযোগ বাড়ছে। সরকার যদি নীতি সহায়তা দেয়, তাহলে অনেক কারখানা তৈরি করা যাবে, তাহলে এই খাত আরও এগিয়ে যাবে। ফার্নিচার বিলাসের পণ্য নয়, প্রয়োজন। এই বিষয় যদি সরকার বিবেচনায় নিয়ে ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে এই খাত আরও সমৃদ্ধ হবে। এ ছাড়া যে শ্রমিকেরা এখানে কাজ করছেন, তাঁদের জন্য যদি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আরও দক্ষ লোক পাওয়া যাবে। আসবাবের অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো কাঠ, কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পিত বনায়ন নেই। বিশ্বের অনেক দেশে আসবাবের জন্য পরিকল্পিত বনায়ন থাকে। সরকার যদি পরিকল্পিত বনায়নের উদ্যোগ নেয়, তাহলে এই খাত আরও এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং তাদের দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।
রপ্তানি বাজার ও নাভানা ফার্নিচারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই।
ইয়ামিন রিখু: নাভানা ফার্নিচার মূলত রপ্তানিনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ জন্য নাভানা ফার্নিচার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরএনডি) টিম ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতিপূর্বে আমরা ছোট আকারে রপ্তানি করলেও ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে রপ্তানির বাজার ধরতে চাই। সে জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা এবং বাজারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করছি। বেসরকারি কোম্পানির একটা দায়িত্ব হচ্ছে, ফার্নিচার উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে নিয়ে আসা, সে ক্ষেত্রে ভোক্তাশ্রেণি উপকৃত হবে। এর পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে চাহিদা বজায় রেখে জায়গা কম লাগে এমন আসবাব, মাল্টিফাংশনাল ফার্নিচার ডিজাইন করে ক্রেতাদের উপকারে আসতে আমরা আরও গুরুত্ব নিয়ে কাজ করব।
বাণিজ্য মেলায় ক্রেতাদের কাছে নাভানা ফার্নিচার কী বার্তা পৌঁছাতে চায়? এবারের বাণিজ্য মেলার বিশেষত্ব কী ছিল?
ইয়ামিন রিখু: একসময় চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে হাতের নকশা ও মৌলিক ফার্নিচার আমদানি হতো। গত ২০ থেকে ২৫ বছরে চীনের ফার্নিচার ও অফিসের ফার্নিচারের বিকল্প হিসেবে নাভানা ফার্নিচারসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ফার্নিচার তৈরি করতে পেরেছে। ফলে চীন থেকে আমদানি একেবারে কমে আসছে। সম্প্রতি আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চীনের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশ থেকে ফার্নিচার আমদানি করছে। নাভানা ফার্নিচার এবারের মেলায় এমন কিছু ফার্নিচার ডিজাইন করেছে, যেগুলো ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশ থেকে আমদানি করা ফার্নিচারের বিকল্প ধাঁচের। ফলে এই ফার্নিচার যাঁরা আমদানি করে ব্যবহার করতেন, তা যেন আর করতে না হয়, নাভানা ফার্নিচার সেই চাহিদা পূরণ করবে। এটাই ছিল এবারের মেলার বিশেষত্ব। সেই মানের আমাদের কয়েকটা ডাইনিং, সোফা ও খাট মেলায় শুরু থেকে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই মেলার মাধ্যমে আমরা ক্রেতাদের একটা বার্তা দিতে চাই, তা হলো, বাংলাদেশে সব ধরনের আসবাব তৈরি করা সম্ভব। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করলে আমদানি খরচ কমে আসবে এবং ডলার খরচ হবে না।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ইয়ামিন রিখু: আপনাকেও ধন্যবাদ।