রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য শক্তিশালী অর্থনীতির চিত্র, নাকি দুর্বলতা? এমনকি প্রশ্ন উঠেছে এর ব্যবহার নিয়েও। একটি দেশ তার ৩ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ রাখবে, এটাই রীতি হিসেবে মানা হয়। বাংলাদেশে এখন তা ৯ মাসের সমান। বেশি রিজার্ভ মূলত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য বাড়ায়।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার তিন বছর পর দেশে রিজার্ভ ছিল সাড়ে ১৮ কোটি ডলার। সেই রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতেও হয়তো খুব সময় লাগবে না।
কোভিড-১৯–এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন মন্দায়, তখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধিকে স্বস্তিদায়ক মনে করছে সরকার। এমনকি রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যায় কি না, তা পর্যালোচনা করেও দেখছে সরকার। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও রিজার্ভ থেকে ঋণ পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অবশ্য রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে বিনিয়োগের আলোচনা এবারই প্রথম নয়। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময়ও এটা নিয়ে কমিটিও করা হয়েছিল। কিন্তু সে আলোচনা আর এগোয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসের মধ্যে আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ইত্যাদি। আর ব্যয়ের বড় জায়গা হচ্ছে আমদানি ব্যয়, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ।
২০১৫ সালে রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সে সময় গভর্নর আতিউর রহমান বলেছিলেন, ‘অনেক দেশ ঘাটতির সমস্যায় থাকে। কিন্তু আমরা আছি মধুর সমস্যায়, উদ্বৃত্তের সমস্যায়। এটি অত্যন্ত সুখের কথা।’ অবশ্য এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি করে সেই মধুর সমস্যার খানিকটা সমাধান করে দিয়েছিল হ্যাকাররা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার এই প্রাদুর্ভাবের সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধির তথ্য সুসংবাদ, না দুর্ভাবনার? এটা শক্তিশালী অর্থনীতির চিত্র, নাকি দুর্বলতা?
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-১৯৭২ অনুযায়ী, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। আগে রিজার্ভ সোনার আকারে রাখার নিয়ম ছিল। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা না থাকায় এখন রূপান্তরযোগ্য নানা বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ অন্য দেশের নানা ধরনের সরকারি পেপারে বা ঝুঁকিহীন উচ্চ ঋণমানের সার্বভৌম বন্ডে বিনিয়োগ করে। কিছু অংশ দিয়ে সোনা কিনে রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসের মধ্যে আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ইত্যাদি। আর ব্যয়ের বড় জায়গা হচ্ছে আমদানি ব্যয়, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি লিখিত নির্দেশনা আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)।
সাধারণত, একটি দেশ তার ৩ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ রাখবে, এটাই রীতি হিসেবে মানা হয়। বাংলাদেশে এখন তা ৯ মাসের সমান। বেশি রিজার্ভ মূলত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য বাড়ায়। অর্থ প্রত্যাবাসন সহজ হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে, এই আস্থা তৈরি হয়। দেশের ঋণমান নির্ধারণে রিজার্ভের গুরুত্ব আছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে অলস পড়ে থাকে না। এর নানা ধরনের কার্যকারিতা আছে। অথচ কেউ কেউ মনে করেন, অলস পড়ে আছে বলে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। আর নতুন অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশ এবার বৈদেশিক সাহায্যও পেয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭২৭ কোটি ডলার সাহায্য পেয়েছে, প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ।
বাণিজ্য ভারসাম্য কখনোই বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। রপ্তানির চেয়ে সব সময়ই আমদানি ব্যয় বেশি। তবে গত দুই অর্থবছরে রপ্তানি ও আমদানি—দুটোই কমেছে। কিন্তু করোনার সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রপ্তানির প্রবৃদ্ধি দশমিক ৯৭ শতাংশ, অন্যদিকে তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক, (-) ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সচল না হওয়ায় আমদানি কমে গেছে।
বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না বলে কাঁচামাল ও পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি কম হচ্ছে। সরকারের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন শ্লথ হয়ে পড়ায় ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধও কম করতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম কমায় এ খাতেও ব্যয় কম।
রিজার্ভ বৃদ্ধিতে এখন বড় ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। আর নতুন অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশ এবার বৈদেশিক সাহায্যও পেয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭২৭ কোটি ডলার সাহায্য পেয়েছে, প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১ শতাংশের কিছু বেশি। বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি আগেও ভালো ছিল না, করোনায় আরও কমেছে। আবার করোনার কারণে বিদেশভ্রমণও কমে গেছে। হজে যাওয়া বন্ধ ছিল, ওমরাহ পালনও তেমন হয়নি। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া বন্ধ, শিক্ষাভ্রমণেরও একই অবস্থা। এসব কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অনেক কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরাও মনে করেন, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, একটা বড়সড় রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করবে। বড় সংকটের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কতটা কার্যকরী হয়, তার উদাহরণ হচ্ছে ২০০৮-০৯ সময়ের ব্রাজিল ও মেক্সিকো।
ভারতের সঙ্গে অর্থনীতির তুলনা নিয়ে কিছুদিন আগে বেশ তোলপাড় হলো। সেই ভারতে এখন প্রতি সপ্তাহে ৫ বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ বাড়ছে। এর পরিমাণ এখন ৫৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ভারতেও রিজার্ভের ব্যবহার নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। ২০০৭ সালেও সেখানে রিজার্ভের অর্থ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) তাতে সম্মতি দেয়নি। এবারও আরবিআই সার্বভৌম বন্ডেই বিনিয়োগ করার কথাই ভাবছে।
সবার অবস্থা ভারত বা বাংলাদেশের মতো না। করোনার এ সময়ে অনেক দেশেরই ব্যয় বাড়ায় কমছে রিজার্ভ। নিজের দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে বেশ কিছু দেশ রিজার্ভ ব্যবহার করেছে। ব্যাংক অব আমেরিকার হিসাবে, উঠতি বাজারের দেশগুলো এ সময়ে ২৪০ বিলিয়ন ডলার এ কাজে ব্যয় করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরাও মনে করেন, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, একটা বড়সড় রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করবে। বড় সংকটের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কতটা কার্যকরী হয়, তার উদাহরণ হচ্ছে ২০০৮-০৯ সময়ের ব্রাজিল ও মেক্সিকো। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই সময়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্রাজিল ভালো করলেও মেক্সিকো ছিল ব্যর্থ। কারণ, অর্থনীতিকে ঠেকা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ ব্রাজিলের ছিল, যা মেক্সিকোর ছিল না। ফলে সে সময় ব্রাজিল তার মুদ্রার মূল্যমান ধরে রাখতে পেরেছিল, মেক্সিকোর পরিস্থিতি ছিল উল্টো।
এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ বিনিয়োগের চিন্তা খুবই বাজে ও বিপজ্জনক। সামনে কী ধরনের সংকট আসবে, তা যেমন জানা নেই, করোনার টিকা কিনতে কী পরিমাণ অর্থ লাগবে, তা–ও নিশ্চিত না। সুতরাং রিজার্ভ ধরে রাখাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেষ কথা হচ্ছে, রিজার্ভ যে বাড়ছে, তা পুরোপুরি শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে, না দুর্বলতার জন্য, সে প্রশ্ন তো আছেই। তবে রিজার্ভের অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা যে উচিত নয়, তা নিয়ে কিন্তু বিশ্বের কোথাও প্রশ্ন নেই।