দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য দেশ হিসেবেই এত দিন শ্রীলঙ্কার পরিচিতি ছিল। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয়, জনকল্যাণ—সব সূচকেই তারা এগিয়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা সফর করে মানুষের দুর্দশার চিত্রই দেখতে হলো। যেদিন শ্রীলঙ্কায় পৌঁছালাম, সেদিন ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। জ্বালানিস্বল্পতার কারণে সরবরাহ–সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে তখন। মানুষের মনে অসন্তোষ। সরকারের প্রতি মানুষের একধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে—জাতীয় সরকারের দাবি করছে জনগণ।
শ্রীলঙ্কার এ অবস্থা দেখে বুঝতে হয়, অর্থনীতি যত ভালোই থাক না কেন, ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনা করা না গেলে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন। শ্রীলঙ্কার এ পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। অর্থনীতিবিদেরাও অনেক দিন ধরে এসব বলে আসছিলেন। কিন্তু তাঁদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। এ সবকিছু পাশ কাটিয়ে তারা হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারত, কিন্তু কোভিড ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মতো দ্বৈত দুর্ঘটনার কারণে তারা আরও বিপাকে পড়েছে।
দেশটির অর্থনীতি মূলত তিনটি খাত ঘিরে ঘুরপাক খায়—তৈরি পোশাক, পর্যটন ও চা। অর্থনীতির বহুমুখীকরণ করতে পারেনি তারা। আর কোভিডের সময় দেখা গেল, যেসব দেশ পর্যটনের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তারাই বেশি মার খেয়েছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। গত দুই বছরে পর্যটন খাত থেকে তারা তেমন একটা রাজস্ব আয় করেত পারেনি। অথচ পর্যটন থেকে তারা বছরে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার উপার্জন করে। বস্তুত কোভিডের আগে ২০১৯ সালে কলম্বো শহরে ইস্টার সানডে চলার সময় কয়েক দফা বোমা হামলায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর থেকেই পর্যটক কমতে শুরু করে শ্রীলঙ্কায়। তবে গত বছর কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক আসা শুরু হলেও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর আরেক দফা ধাক্কা খায় শ্রীলঙ্কা। কারণ, তাদের পর্যটকদের বড় একটি অংশ রুশ নাগরিক। এখানেই শেষ নয়, শ্রীলঙ্কার চায়ের বড় বাজার হচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে।
কৃষি উৎপাদন কমেছে শ্রীলঙ্কার। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কায় সার ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় ধান ও চায়ের উৎপাদন কমে যায়। এ ছাড়া দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় সাড়ে তিন হাজারের বেশি। ফলে সেখানে শ্রমিকের মজুরি বেশি। এত মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষির যন্ত্রীকরণ শুরু করেছিল তার, কিন্তু উৎপাদন শেষমেশ বৃদ্ধি করতে পারেনি।
মূলত বড় প্রকল্পগুলো সফলতার মুখ না দেখায় বিপাকে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। সম্ভাব্যতা যাচাই না করে তারা যেভাবে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেগুলোর অর্থায়ন করতে তাদের বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। এমন এক বিমানবন্দর তারা নির্মাণ করেছে, যেখানে দিনে বিমান ওঠানামা করে হাতে গোনা কয়েকটি। ফলে এখন যখন ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, তখন তারা বিপাকে পড়েছে।
এত দিন শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে যায়নি, কিন্তু এখন উপায়ন্তর না দেখে তারা যাচ্ছে। আইএমএফ যথারীতি কিছু শর্ত দিয়েছে। এ ছাড়া ভারতের সহায়তায় ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কার বন্দরে ৪০ হাজার টন ডিজেলবাহী এক জাহাজ ভিড়েছে। চীনের কাছেও তারা সহায়তা চেয়েছে।
বাংলাদেশেও এখন বড় বড় প্রকল্প চলছে। ফলে এ বাস্তবতা থেকে আমাদেরসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। প্রথমত, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই না করলে কী হয়, শ্রীলঙ্কা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এরপর আমরা দেখলাম, সুশাসন না থাকলে কী হতে পারে, এ নিয়ে বাংলাদেশে তো কম কথা হলো না।
বাংলাদেশের সুবিধা হলো, এখানে যেসব অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে, তার ব্যবহার না হওয়ার সুযোগ কম। এখানে জনসংখ্যা অনেক বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে উপকারভোগীর নিরিখে মাথাপিছু প্রকল্প ব্যয় কম হয়। প্রকল্পের সেবার মূল্যও কম রাখা যায়। তাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধা আছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে আরও গতি আসবে।
শিল্পায়নের কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও থাকবে। এ ছাড়া আমাদের ঋণের পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩৭ শতাংশ এসেছে বিদেশি উৎস থেকে, পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ।
আর ঋণ দিয়ে নির্মিত অবকাঠামো আর তার আয় দিয়ে ঋণের পরিষেবা—এ সমীকরণের ব্যত্যয় হয় প্রকল্পের ব্যয় যখন অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যায়, আয় ও ঋণ পরিষেবার ক্ষেত্রে সময়ের সামঞ্জস্য যখন বিঘ্নিত হয়।
শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা আমাদের তথ্য-উপাত্তনির্ভর নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পেশাদারি, যৌক্তিক প্রাক্কলন, বাছাই ও প্রকল্পের আয় ও ঋণ পরিষেবার মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে শেখায়।
তবে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের কাতারে প্রবেশ করেছি। ফলে ঋণের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে। এ বাস্তবতায় আমাদের ঋণ গ্রহণ বা প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাবধান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। সবচেয়ে বড় কথা সুশাসন। সব ক্ষেত্রে সুশাসন থাকলে আমরা বিপদ ও ঝুঁকি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারব।