ফরাসি লেখক ও দার্শনিক ভলতেয়ার ১৭৯৪ সালে লিখেছিলেন, ‘তুমি যদি একজন সুইস ব্যাংকারকে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিতে দেখো, তাহলেও তাকে অনুসরণ করো, নিশ্চিত জেনো সেখানে অবশ্যই মুনাফা করার মতো কিছু আছে।’
সুইজারল্যান্ডের অনেক সুনাম আছে। সুইস চকলেট পৃথিবীসেরা। ভারী শিল্পেও দেশটির সুনাম আছে। পনির খেতে হলে যেতে হবে সুইজারল্যান্ডে। দেশটিকে বিশ্বের ব্যাংক খাতের রাজধানী বলা হয়। এবার একটু দুর্নামও করা যাক। কালোটাকা গোপন রাখার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা কিন্তু সুইজারল্যান্ড। সুইস ব্যাংকের সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি বিশ্বজোড়া।
ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখাটাই এ দেশের আইন। এ কারণেই আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক শাসক-স্বৈরশাসক, রাজনীতিবিদ এবং উন্নত বিশ্বের অসাধু ব্যবসায়ীদের অর্থ লুকিয়ে রাখার বড় জায়গা এই সুইস ব্যাংক। অর্থ বা সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য এর চেয়ে বড় জায়গা পৃথিবীতে নেই।
ইদানীং অবশ্য প্রশ্ন উঠছে, চাপও বাড়ছে সুইস ব্যাংক ব্যবস্থার ওপরে। ফলে গোপনীয়তা আইন থেকেও খানিকটা সরে আসতে হয়েছে সুইজারল্যান্ডকে। বছর শেষে গচ্ছিত অর্থের হিসাব প্রকাশ করে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বাংলাদেশের নাগরিকদের রাখা ব্যাংক হিসাবের তথ্যও পাওয়া যায়। এটাও এক ধরনের অগ্রগতি। তবে এখন অনেক দেশই গ্রাহকের তথ্য পাওয়ার চুক্তিও করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে তবে কি সুইস ব্যাংক তার জৌলুশ হারাচ্ছে? সুইজারল্যান্ড কি আর অর্থ গোপন রাখার নিরাপদ জায়গা নয়?
সুইস ব্যাংকব্যবস্থার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সুইস ব্যাংক, গোপন অর্থ আর গোপনীয়তা—এই তিন বিষয়ও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর এই গোপনীয়তার শুরু সপ্তদশ শতকের শুরু থেকেই। মূলত তখন ইউরোপের অভিজাত শ্রেণিকে রক্ষা করার জন্যই ১৭১৩ সালে গ্রেট কাউন্সিল অব জেনেভা ব্যাংক গোপনীয়তা আইন প্রণয়ন করেছিল। এখানে অবশ্য ধর্মেরও একটা ভূমিকা ছিল। পাশের দেশ ফ্রান্সের ব্যাংকগুলো ছিল মূলত খ্রিষ্টীয় ধর্মের প্রোটেস্ট্যান্টদের দখলে। ক্যাথলিকেরা এসব ব্যাংকে অর্থ রাখতে আগ্রহী ছিলেন না। ফ্রান্সের সে সময়ের ক্যাথলিক রাজাও তখন সুইস ব্যাংকগুলোতে অর্থ রাখা শুরু করেন। ১৭৮০ সালের দিকে সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ বিমার আওতায় নিয়ে এলে আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার হয়। ১৮১৫ সালে সুইজারল্যান্ড একটি নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা পেলে সুইস ব্যাংকে অর্থপ্রবাহ অনেক বেড়ে যায়।
ছোটখাটো এক গৃহযুদ্ধের পরে ১৮৪৮ সালে গঠিত হয় সুইস ফেডারেশন। শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক কাঠামো দেশটিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেয়, যা ব্যাংকের গোপনীয়তা নীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। নিরপেক্ষ দেশ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে আছে ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য গোপন করার নীতি, ফলে সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে।
মূলত দু–দুটি বিশ্বযুদ্ধই সুইস ব্যাংকের ব্যবসাকে রমরমা করে তুলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই সুইস ব্যাংকাররা নিজ নিজ ব্যাংকের বিজ্ঞাপন প্রচারে ফ্রান্স সফর শুরু করেন। লক্ষ্য, দেশটির অভিজাত ও ধনী শ্রেণি। আর বিজ্ঞাপনে মূল আকর্ষণ হিসেবে ব্যাংক গোপনীয়তা আইনের কথাই প্রচার করা হতো। যুদ্ধ অনিশ্চয়তা তৈরি করে, যা অর্থনৈতিক সংকটের বড় কারণ। এর ফলে সুইস ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অর্থ আসা শুরু হয়। আবার যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহে ইউরোপের অনেক দেশই নতুন যুদ্ধকর আরোপ করেছিল। এতে সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসা আরও বেড়ে যায়। কর ফাঁকি দিতেই এ সময় ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে ভিড় বাড়াতে থাকেন।
সুইস ব্যাংক গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগোয় ১৯৩৪ সালে। এর আগে ব্যাংকের গ্রাহকের তথ্য ফাঁস করলে তা দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। সুইস ফেডারেল অ্যাসেম্বলি নতুন আইন করে। এই আইনে গ্রাহকের তথ্য ফাঁস ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখার ক্ষেত্রে নতুন এই আইনকে একটি মাইলফলক হিসেবেই মনে করা হয়। সে সময় ফ্রান্স ও জার্মানি নিজের দেশের নাগরিকদের কর ফাঁকি বন্ধে সুইস ব্যাংকগুলোর শাখায় অভিযান চালিয়েছিল। এতে অনেক গোপন নাম ফাঁস হয়ে যায়। ফলে গোপনীয় আইন আরও কঠোর করা হয়।
জার্মানিতে নাৎসি দল ও হিটলারের উত্থান এবং তাঁর ইহুদিবিরোধী মনোভাব সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসা আরও বাড়িয়ে দেয়। সুইস ব্যাংকগুলো এ সময় নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদিদের সম্পদ রক্ষার কাজটি করে। অবশ্য এর সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত। ধনী ইহুদিরা তাঁদের সম্পদ সুইস ব্যাংকগুলোতে রাখা শুরু করেন। আবার একই সঙ্গে তাঁরা নাৎসি ও তাঁদের সহযোগীদের অর্থ এবং সোনা মাটির নিচে ভল্টে রাখার ব্যবস্থাও নেন। বলা হয়, ইহুদি নিধনের আগে নাৎসি নেতারা তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে লুকিয়ে রাখতেন। এমনকি সুইস ব্যাংকে রাখা সম্পদ নিজের নামে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিলেন অনেক নাৎসি প্রভাবশালী সদস্য।
অ্যাডলফ হিটলারও ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডে (ইউবিএস) অর্থ রেখেছিলেন। এর পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি রেইচমার্ক (সে সময়ে জার্মানির মুদ্রা, ১৯৪৮ সালে তা বদলে ডয়েসমার্ক হয়)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদিদের সম্পদ উদ্ধারে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হলে চাপ বাড়ে সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর। এর ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে হিটলারের জমা রাখা অর্থ ফেরত চায়। ইউবিএস ৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ফেরতও দেয়। মালিকানা না থাকলে এবং তা জব্দ করা হলে কী পরিমাণ অর্থ কোনো কর্তৃপক্ষকে ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন আছে। বলা হয়, নাৎসিবিরোধীদের সম্পদ রক্ষা করছে বলে হিটলার ১৯৪০ সালে সুইজারল্যান্ড দখল করার কথাও ভেবেছিলেন। যদিও পরে তা আর কার্যকর করেননি।
ক্রিস্টোফ মেইলি এক সময় ইউবিএসের নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে তথ্য দেন যে ব্যাংকটি ইহুদি গণহত্যা বা হলোকস্ট সময়ের সব ধরনের নথি পুড়িয়ে ফেলেছিল, যাতে গচ্ছিত সম্পদের মালিকানার প্রমাণ না থাকে। এ নিয়ে একাধিক মামলা হলে হত্যার শিকার ইহুদিদের পরিবারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে হয়। এ জন্য ইউবিএসকে ১২৫ কোটি ডলার দিতে হয় আর ক্রিস্টোফ মেইলি পান সাড়ে সাত লাখ ডলার।
পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার পরে। এ সময় সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। আবার ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ব্যাংকের গোপনীয়তা আইন ভঙ্গের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়। কিন্তু তার আগেই বড় ধাক্কাটি দেয় আরেক মার্কিন নাগরিক।
ঘটনাটি ২০০৭ সালের। ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ডের গল্পটা ‘বার্কেনফিল্ড ডিজক্লোজার’ নামে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। বলা যায়, সুইস ব্যাংকের রমরমা ব্যবসা কমিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ড সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। মার্কিন নাগরিক বার্কেনফিল্ড কাজ করতেন সুইস ব্যাংক ইউবিএস-এ। তিনিই প্রথম সুইস ব্যাংকিং সিক্রেসি আইন ভেঙেছিলেন। ২০০১ সালে তিনি জেনেভায় ইউবিএসে যোগ দিয়েছিলেন সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে। আর ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন ২০০৫ সালে। এর আগে তিনি ব্যাংকের করা কিছু অভ্যন্তরীণ নথি দেখেছিলেন, যা তৈরি করেছিল ব্যাংকটির আইন বিভাগ। নথিতে মার্কিন গ্রাহকদের নিয়ে কাজ করেন, এমন সম্পদ ব্যবস্থাপকদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।
নথিতে বলা ছিল, এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিষ্ঠান দায়ী থাকবে না, সব দায় নিতে হবে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের। এ নিয়ে আপত্তির কথা বার্কেনফিল্ড ঊর্ধ্বতনদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। এরপরই তিনি পদত্যাগ করেন। কেননা, মার্কিন নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখার ব্যবস্থা বার্কেনফিল্ডই করতেন। আর ধনী আমেরিকানদের আকৃষ্ট করতে সুইস ব্যাংকগুলো ইয়ট রেসসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করত।
২০০৭ সালেই বার্কেনফিল্ড মার্কিন বিচার বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি হুইসেলব্লোয়ার আইনের অধীনে তথ্য দিতে চান। এই আইন অনুযায়ী কেউ যদি ভেতরের তথ্য দেন এবং এতে কর ফাঁকির ঘটনা উদ্ধার হয়, তবে মোট আদায়ের ৩০ শতাংশ তথ্য প্রদানকারী বা হুইসেলব্লোয়ার পাবেন। একই সঙ্গে তিনি কোনো ধরনের বিচার থেকে দায়মুক্তিও চান। তবে বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে গেলে বার্কেনফিল্ড ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) যোগাযোগ করেছিলেন।এরপরই মার্কিন তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই তদন্ত শুরু করে।
তদন্তে দেখা যায়, সুইস ব্যাংকগুলোতে বিপুলসংখ্যক মার্কিন নাগরিকের অর্থ গচ্ছিত আছে, আর এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য অভিযুক্ত করা হয় দুটি বড় ব্যাংককে। যেমন ইউবিএস এবং এলজিটি গ্রুপ। এর মধ্যে ইউবিএসে ১৯ হাজার মার্কিন নাগরিকের হিসাবে গচ্ছিত ছিল ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে ২ হাজার কোটি ডলার।তথ্য ফাঁস করলেও বার্কেনফিল্ডের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া ঠিকই শুরু করে মার্কিন বিচার বিভাগ। দেশটির অন্যতম ধনী ইগন ওলেনিকফকে কর ফাঁকি দিতে সহায়তার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে ৪০ মাসের জেল হয় বার্কেনফিল্ডের। জেল খেটে মুক্তি পান ২০১২ সালের ১ আগস্ট। তবে একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর বার্কেনফিল্ড আইন অনুযায়ী হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে ১০ কোটি ৪ লাখ ডলার পুরস্কার পান।
এই ঘটনায় ইউবিএসকে ৭৮ কোটি ডলার জরিমানা করলে তারা তা দিতে বাধ্য হয়।পথ খুলে দিল অন্যদেরমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত অনেক দেশের জন্যই নতুন পথ খুলে দেয়। বিভিন্ন দেশ সুইস ব্যাংকের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অর্থ গচ্ছিত রাখার অভিযোগ এনে তদন্ত শুরু করে। ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও ইসরায়েল একই ধরনের তদন্ত শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এতে সুইস ব্যাংকগুলো জরিমানা দিয়েও যাচ্ছে।
২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউবিএসের বিরুদ্ধে একটা মামলা করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। মামলায় ব্যাংকটির কাছে ৫২ হাজার মার্কিন নাগরিকের তথ্য চাওয়া হয়। এরপরই পররাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োগ পান হিলারি ক্লিনটন। একই বছরের মার্চে তিনি জেনেভা সফরে গেলে বিষয়টির একধরনের নিষ্পত্তি করা হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে সুইস ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট সুপারভাইজারি অথরিটি (এফআইএনএমএ) ৫২ হাজারের মধ্যে ৪ হাজার ৪৫০ জনের তথ্য সরবরাহ করবে। তবে এ নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এ বিষয়ে সিনেটে অনুষ্ঠিত শুনানির প্রধান ছিলেন সিনেটর কার্ল লেভিন। তিনি একে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছিলেন।
মূল ভূমিকাটি বারাক ওবামার। তিনি ক্ষমতায় আসার পরেই যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাস করে। এর নাম ‘ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট (এফএটিসিএ)’। মূলত মার্কিন নাগরিকদের কর ফাঁকি বন্ধেই আইনটি করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নয়, এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য দিতে হবে। সুইজারল্যান্ডকেও এই চুক্তি মানতে হচ্ছে। না মানলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেউ ব্যবসাই করতে পারবে না।সুইজারল্যান্ড মূলত চাপে পড়েই গোপনীয়তার নীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের করা এই আইনই অনেকের জন্য নতুন পথ খুলে দেয়।
অনেক দেশই একই ধরনের আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালে জি-২০ ও ওইসিডিভুক্ত ৪৭টি দেশ এই লক্ষ্যে একটি নতুন ব্যবস্থা নিতে সম্মত হয়। তথ্য আদান-প্রদানের একটি অভিন্ন প্রক্রিয়া বা ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়। মূলত এটি একটি স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় কাঠামো বা অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন ব্যবস্থা। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ দেশ এই কাঠামোর আওতায় চুক্তি করেছে। ফলে তারা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য পাচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে সুইস সরকার জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন একটি চুক্তি করে। এর নাম রুবিক চুক্তি। এতে বলা আছে, কোনো গ্রাহক যদি ধার্য করা কর পরিশোধ করে দেন, তাহলে সুইস ব্যাংক তাঁদের নাম প্রকাশ করবে না। অনেকটা কালোটাকা সাদা করার নীতির মতোই।
সুইস ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য এখনো তাদের ওয়েবসাইটে লিখে রেখেছে, গোপনীয়তার অধিকার সুইস আইন ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যা ফেডারেল সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। তবে অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থ গচ্ছিত রাখলে তা এই সুরক্ষা পাবে না। আর এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় প্রকাশেও কোনো বাধা নেই। তবে অপরাধের সঙ্গে গ্রাহকের সম্পৃক্ততার আইনি প্রমাণ দেখাতে হবে।
তবে বাংলাদেশ এখনো এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। ভারত এরই মধ্যে এই কাঠামোর আওতায় তথ্য পেতে শুরু করেছে। পাকিস্তান, এমনকি মালদ্বীপও এই কাঠামোতে স্বাক্ষর করা দেশ। কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) একটি দেশের আর্থিক খাত–সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়। এ জন্য এ খাতের স্থিতিশীলতা যেমন একটু গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত, তেমনি আর্থিক খাতকে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন ও মান অনুসরণ করতে হয়। বাংলাদেশের সংকট এখানেই। এখানে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয় কারও না কারও ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে, অর্থমন্ত্রী বদল হলেও অনেক কিছু পাল্টে যায়, নানা ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সুতরাং কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) মানতে হলে করব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের বড় ধরনের সংস্কার লাগবে। এসব ক্ষেত্রে অভিন্ন আন্তর্জাতিক মান বজায় না রাখলে স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় কাঠামোর আওতায় অংশই নিতেই পারবে না বাংলাদেশ।
অনেকের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে এইচ এম এরশাদের পতনের পর তাঁর পাচার করা অর্থ উদ্ধার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল এরশাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখা ছিল। এ জন্য ফায়ার ফক্স নামের একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু এর কোনো সুরাহা হয়নি। তখন অবশ্য কোনোভাবেই গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করার নীতি ছিল না। ফলে এরশাদের অর্থ সেখানে রাখা ছিল না তা বলা যাবে না।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের রাখা অর্থের হিসাব প্রথম জানা যায় ২০০৪ সালে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানতে পারে বাংলাদেশের মানুষ। তবে এ নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি শুরু হয় ২০১৪ থেকে। ওই বছরের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তাঁর সরকার আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে। এর আগের দিন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও তিনি সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা রেখেছে, তা বের করার কথা বলেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সুইজারল্যান্ডের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছিল। এর আগের বছরের (২০১৩) জুলাই মাসে বিএফআইইউ এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ পেয়েছিল। এগমন্ট গ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যারা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি সেটুকুই।
গত ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা আছে, ‘সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে তথ্য আদান-প্রদানসহ একটি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ কর্তৃক অনুসৃত কৌশল পর্যালোচনার জন্য নভেম্বর, ২০১৯-এ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার-সম্পর্কিত মামলা, বিদ্যমান আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তথ্য বিনিময়ের বিভিন্ন জটিলতা, বিভিন্ন দেশের আইনকানুন পর্যালোচনা করে কার্যকর অর্থ উদ্ধার কার্যক্রমের কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে।’ অর্থাৎ এখনো চলছে তথ্য সংগ্রহের কাজ, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
রমরমা ব্যবসার যুগে সুইস ব্যাংকগুলোর সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। কিন্তু চাপ বাড়তে থাকায় কমতে থাকে ব্যাংকের সংখ্যা। যেমন ১৯৯৬ সালে সুইস ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৪০৩টি, ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে ১৫৭টি। আইন ভঙ্গ বা অনিয়মের জন্য এখন পর্যন্ত ৮৫টি সুইস ব্যাংককে ৫৫০ কোটি ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংকের একটি ইউবিএস ২০০৯ সালে জরিমানা দেয় ৭৮ কোটি ডলার এবং আরেক বড় ব্যাংক ক্রেডিট সুইস ২০১৪ সালে জরিমানা দেয় ২৬০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাপী সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও সুইস ব্যাংকের অংশ কমেছে।
সুইস ব্যাংকের ওপর সবচেয়ে চাপ ছিল ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে সুইজারল্যান্ড থেকে চলে গেছে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।তা ছাড়া সুইস ব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বীও দাঁড়িয়ে গেছে। কেইম্যান আইল্যান্ড, পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও বাহামার ব্যাংকিং ব্যবস্থাও ধনীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর্থিক গোপনীয়তা সূচকে এখন পয়লা নম্বরে আছে কেইম্যান আইল্যান্ড। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের নাগরিকেরাও এখন সুইস ব্যাংকে টাকা না রেখে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডার মতো দেশগুলোয় বিনিয়োগের বদলে নাগরিকত্ব সুবিধা নিচ্ছেন।
তারপরও সুইস ব্যাংক জৌলুশ বা গৌরব হারাচ্ছে তা বলা যাবে না। এর বড় কারণ নির্ভরযোগ্যতা। সুইজারল্যান্ড নিরপেক্ষ ও স্থিতিশীল একটি দেশ। সুইস ব্যাংকের টিকে থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে এর সুদহার নীতি। সুইস ব্যাংকে অর্থ রেখে কিন্তু কোনো সুদ পাওয়া যায় না। প্রায় শূন্য সুদ, কখনো কখনো ঋণাত্মক সুদহার। তারপরও এখানে অর্থ রাখা লাভজনক। কারণ, সুইজারল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার আরও কম। ফলে সব মিলিয়ে আড়াই থেকে তিন শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা থাকে, যা অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাপের কারণে সুইস ব্যাংকগুলো এখন বেশি নজর দিচ্ছে উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর প্রতি, বিশেষ করে এশিয়া। এশিয়ার সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এখন ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইস শীর্ষে। নতুন করে যেসব দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি, সেসব দেশের দিকেই এখন তাদের নজর। এ তালিকায় বাংলাদেশের নামও একসময় উঠে আসবে। অথচ টাকা পাচার ঠেকানোর কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই, উদ্যোগও নেই। সুতরাং সুইস ব্যাংক যতই জৌলুশ হারাক, পাচারকারীদের অর্থ পাচারের সুযোগ ও জায়গার অভাব হবে না।