>সিরামিকশিল্পে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে। সম্ভাবনার পাশাপাশি খাতটিতে আছে কিছু প্রতিবন্ধকতাও। এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সাধারণ সম্পাদক ও ফার সিরামিকসের পরিচালক ইরফান উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
প্রথম আলো: চলতি মাসে বেশ বড় পরিসরে সিরামিক পণ্যের প্রদর্শনীর আয়োজন করল বিসিএমইএ। দ্বিতীয়বারের এই আয়োজনে কেমন সাড়া মিলল?
ইরফান উদ্দিন: তিন দিনের প্রদর্শনীতে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো সাড়া পেয়েছি আমরা। পাঁচ শতাধিক বিদেশি ক্রেতা-দর্শনার্থী এসেছিলেন। তাদের অনেকেই আমাদের দেশের টেবিলওয়্যার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রয়াদেশ দিতে খোঁজখবর নিয়েছেন। তাতে ৫৫ লাখ ডলার বিদেশি ক্রয়াদেশ পেয়েছি আমরা। আবার প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে নতুন করে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের সন্ধান পেয়েছেন আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা।
প্রথম আলো: সিরামিক খাতের সম্ভাবনা কেমন? নতুন বিনিয়োগ কি আসছে?
ইরফান উদ্দিন: আমাদের দেশে কেবল টাইলসের বাজারই আছে ৯ হাজার কোটি টাকার। দেশীয় কোম্পানিগুলো সরবরাহ করতে পারছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার টাইলস। দেড় হাজার কোটি টাকার টাইলস আমদানি হচ্ছে। একইভাবে স্যানিটারি ও টেবিলওয়্যার পণ্যের চাহিদা মেটাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে সিরামিক খাতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ আছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিনিয়োগও আসছে। বর্তমানে পাইপলাইনে ১১টি নতুন প্রতিষ্ঠান আছে। ইতিমধ্যে তারা আমাদের সমিতির সদস্যপদও নিয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসবে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের মধ্যে অধিকাংশই টাইলস উৎপাদন করবে। তবে একাধিক স্যানিটারি ও একটি টেবিলওয়্যার কারখানাও আছে। অন্যদিকে যারা বর্তমানে উৎপাদনে আছে, তারাও ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে।
প্রথম আলো: আপনি দেশের বাজারের কথা বললেন। বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের সুযোগ কেমন আছে?
ইরফান উদ্দিন: বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে সিরামিক পণ্য ব্যবহৃত হয় না। এটি বর্তমানে দৈনন্দিন পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। যেসব দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, সেখানে পাল্লা দিয়ে টাইলস, স্যানিটারি ও টেবিলওয়্যার পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। অন্যদিকে মেলামাইন ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বছরে ১২ হাজার কোটি রুপির টাইলস রপ্তানি করে। তারা কিন্তু নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করার পর এই পরিমাণ রপ্তানি করছে। আরও অনেক দেশ টাইলস রপ্তানি করছে। তাদের মধ্যে চীন শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবে দেশটিতে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা বিকল্প দেশ খুঁজছেন। শ্রীলঙ্কা টেবিলওয়্যার ভালো করে, তবে টাইলস নেই। আবার ভারত টাইলসে ভালো করলেও তাদের টেবিলওয়্যার পণ্য নেই। তবে বাংলাদেশে টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য একসঙ্গে বেড়ে উঠছে। পণ্যের মানও ভালো। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ভালো সুযোগ আছে।
প্রথম আলো: চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সিরামিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে ৬৭ শতাংশ। কারণ কী?
ইরফান উদ্দিন: সব সময় ব্যবসা একরকম যায় না। রপ্তানি কমেছে, সত্য। তবে আবার সিরামিক পণ্যের রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশি সিরামিক পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কেমন?
ইরফান উদ্দিন: আমরা কিছু ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। ভারতের নিজস্ব কাঁচামাল আছে। আর আমরা যখন তাদের কাছ থেকে কাঁচামাল আমদানি করি তখন তাতে ৩০ শতাংশ ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) থাকে। ধরুন, ১০ হাজার টন মাটি কিনলে তার মধ্যে ৩ হাজার টন পানি থাকে। মাটিতে পানি থাকবেই। কিন্তু সেই তিন হাজার টন পানি আমরা জাহাজ ভাড়া দিয়ে কিনে আনছি। আবার সেই পানির ওপর শুল্ক দিতে হচ্ছে। অথচ কারখানায় আসার পর আমরা ঠিকই ৭ হাজার টন মাটি পাচ্ছি। ফলে আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই ময়েশ্চারের ওপর শুল্ক ছাড়ের বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি আমরা।
প্রথম আলো: সিরামিক পণ্য উৎপাদনে গ্যাসও তো অন্যতম কাঁচামাল। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণেও কি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছেন আপনারা?
ইরফান উদ্দিন: গ্যাসের অনেক দাম বেড়েছে। কিন্তু আমরা সেটি নিয়ে কোথাও বলছি না। কারণ ২০১৭-১৮ সালে গ্যাস নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তখন আমরা চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পেতাম না। এখন ১০ টাকা বেশি দিলেও গ্যাস তো পাচ্ছি। কারণ, সিরামিকের কারখানা এমন যে আপনি কখনোই এটির উৎপাদন বন্ধ করতে পারবেন না। গ্যাসের বর্তমান দামে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের উদ্যোক্তাদের আরও স্মার্ট হতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের ভ্যালু অ্যাডেড (বেশি মূল্যের) পণ্য রপ্তানিতে যেতে হবে।
প্রথম আলো: সিরামিক পণ্যের আমদানি হ্রাস ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকারের তরফ থেকে কী ধরনের সহায়তা দরকার?
ইরফান উদ্দিন: চলতি অর্থবছরের বাজেটে আমরা ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা চেয়েছিলাম। সরকার দিয়েছে ১০ শতাংশ। আসলে খাতটিকে আরেকটু বিবেচনা করা দরকার। কারণ, টাইলস রপ্তানি শুরু হলে সেটি বড় পরিমাণে হবে। অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানিতে ৩০ শতাংশ ময়েশ্চার থাকার কথা আগেই বলেছি। বিষয়টি বিবেচনা করা হলে কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাতে সিরামিক পণ্যের আমদানি কমবে, বাড়বে রপ্তানিও।