ব্যাংকের বেতন কাঠামো

সিদ্ধান্তটি জনপ্রিয়, টেকসই কি

—ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে। তবে সেটা কত হবে, তা ভেবে দেখার সময় এখনো আছে।
—কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত তার সামগ্রিক প্রভাব ভেবে দেখা। তাহলেই তা টেকসই হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক
ছবি: প্রথম আলো

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সময়ে-সময়ে বেতনকাঠামো নির্ধারণ করে সরকার। পাশাপাশি পোশাকসহ বেসরকারি ৪১টি খাতের শ্রমিকদের মজুরিও নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এ ছাড়া সংবাদপত্রের কর্মীদেরও মজুরিকাঠামো সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়।

এর বাইরে বেসরকারি খাতের কর্মরত বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আর কোনো বেতনকাঠামো নির্ধারণ করা নেই। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব সক্ষমতা, কর্মীদের যোগ্যতা ও পারফরম্যান্স অনুযায়ী বেতন-ভাতা দিয়ে থাকে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানভেদে বেতনকাঠামোও ভিন্ন ভিন্ন। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের ব্যাংকেরও। ব্যাংকভেদে কর্মীদের বেতনকাঠামোও ভিন্ন ভিন্ন।

এমন এক পরিস্থিতিতে গত মাসে প্রথমবারের মতো বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী মাস থেকে ন্যূনতম এ বেতন-ভাতা কার্যকরের কথা রয়েছে। ২০২০ সাল শেষে বিদেশিসহ বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় জনবল ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৪ জন। এর মধ্যে বিদেশি ব্যাংকগুলোর কর্মী ৩ হাজার ৮৭০ জন। পুরো ব্যাংক খাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ কর্মী থাকলেও মূলত বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বনিম্ন বেতনকাঠামো কার্যকর হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত ব্যাংকারসহ বিভিন্ন মহলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে খুশি ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ জন্য ব্যাংকাররা বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশেষত গভর্নরকে আন্তরিক ধন্যবাদও জানাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া বেতন-ভাতা অনুযায়ী, শিক্ষানবিশকালের জন্য জেনারেল ব্যাংকিংয়ের কর্মকর্তাদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা হবে ২৮ হাজার টাকা এবং ক্যাশ শাখার কর্মকর্তাদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা হবে ২৬ হাজার টাকা। আর শিক্ষানবিশকাল শেষে জেনারেল শাখার কর্মকর্তাদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা হবে ৩৯ হাজার এবং ক্যাশ শাখার কর্মকর্তাদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা হবে ৩৬ হাজার টাকা। একইভাবে ওপরের সারির কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাও পুনর্নির্ধারণ করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত ব্যাংকারসহ বিভিন্ন মহলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে খুশি ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ জন্য ব্যাংকাররা বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশেষত গভর্নরকে আন্তরিক ধন্যবাদও জানাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে জনগণকে খুশি করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রকল্প গ্রহণ করতে দেখা যায়। তাতে খুশি হয়ে জনগণ সরকারকে ধন্যবাদও জানায়। ঠিক তেমনভাবেই গভর্নরের মেয়াদ শেষের প্রায় ছয় মাস আগে নেওয়া এই এক সিদ্ধান্ত যেন বদলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চরিত্র।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় লাখ টাকা বেতনের কর্মকর্তা যেমন রয়েছে, তেমনি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতনের কর্মকর্তাও রয়েছে। ফলে ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে। তবে সেটা কত হবে, তা ভেবে দেখার সময় এখনো আছে।

ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দেওয়ার আইনি ক্ষমতা নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে গিয়ে খুব তড়িঘড়ি করে ফেলেছে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ জন্য দেশের কর্মসংস্থান ও ব্যাংকের আয়ে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কিনা এ প্রশ্নও উঠেছে। আর শিক্ষানবিশকাল শেষে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ৩৯ হাজার টাকা হলে তা সরকারি কর্মচারীদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালকদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। তার প্রভাব কী হতে পারে, সেটি নিয়েও রয়েছে নানাজনের নানা মত।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় লাখ টাকা বেতনের কর্মকর্তা যেমন রয়েছে, তেমনি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতনের কর্মকর্তাও রয়েছে। ফলে ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে। তবে সেটা কত হবে, তা ভেবে দেখার সময় এখনো আছে।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, নতুন এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে তাতে আগামী কয়েক বছর ব্যাংকে নতুন নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের কর্মসংস্থানে। কারণ, প্রতিবছর বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় গড়ে পাঁচ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। একইভাবে ব্যাংকগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য শাখা, উপশাখা খোলাও কমিয়ে দেবে। এর বাইরে আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হওয়ার বিষয় তো আছেই।

নতুন বেতনকাঠামোর ফলে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ করা কর্মীও কমিয়ে আনতে হবে। এখন আর কর্মী নিয়োগে চুক্তি না করে কাজের হিসাবে চুক্তি করতে হবে। আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানই ঠিক করবে, কত টাকা বেতন দেবে ও কতজনকে দিয়ে কাজ করাবে। ব্যাংক প্রতি মাসে শুধু নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা একটি হিসাব দিয়ে বলেন, আগে উপজেলায় ছোট শাখা বা এসএমই সেন্টার চালাতে একজন অফিস সহায়ক, একজন নিরাপত্তাকর্মী, দুজন কর্মকর্তা ও একজন ব্যবস্থাপকের পেছনে বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হতো সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। এখন সেই খরচ বেড়ে আড়াই লাখ টাকা হয়ে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাই বেঁধে দেয়নি; ব্যাংকের কর্মচারী বা চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া অফিস সহায়কদের দিকেও উদার হাত বাড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সব বিভাগীয় শহরের জন্য বেতন-ভাতা ঠিক করা হয়েছে ২৪ হাজার টাকা, জেলা শহরের জন্য ২১ হাজার টাকা ও উপজেলার জন্য ১৮ হাজার টাকা।

ব্যাংকগুলোয় এখন চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া অফিস সহায়কেরা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছেন। বর্তমানে তাঁরা মাসে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই সেবা দেওয়ার জন্য চুক্তি করে।
বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, নতুন বেতনকাঠামোর ফলে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ করা কর্মীও কমিয়ে আনতে হবে। এখন আর কর্মী নিয়োগে চুক্তি না করে কাজের হিসাবে চুক্তি করতে হবে। আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানই ঠিক করবে, কত টাকা বেতন দেবে ও কতজনকে দিয়ে কাজ করাবে। ব্যাংক প্রতি মাসে শুধু নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করবে। এতে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে কর্মসংস্থান হয়েছিল, তাও হুমকির মুখে পড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কার্যকর হলে রাজধানীর নিরাপত্তাকর্মীকে দিতে হবে ২৪ হাজার টাকা। ফলে, একটি বুথের নিরাপত্তায় ব্যাংকের খরচ ২৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হবে ৭২ হাজার টাকা।

এদিকে এখন একটি এটিএম বুথ পরিচালনায় তিনজন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করেন। ৮ ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালনে পান ৮ হাজার টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কার্যকর হলে রাজধানীর নিরাপত্তাকর্মীকে দিতে হবে ২৪ হাজার টাকা। ফলে, একটি বুথের নিরাপত্তায় ব্যাংকের খরচ ২৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হবে ৭২ হাজার টাকা।
তাহলে কী হবে, এ নিয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি এক ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক আর কোনো নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেবে না। কোনো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেবে, তারা নিরাপত্তার কাজটি কী দিয়ে ও কতজন কর্মীকে দিয়ে সম্পন্ন করবে, সেটা তাদের বিষয়।

এভাবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা বেঁধে দেওয়ার নজির সম্ভবত অন্য কোনো দেশে নেই। উন্নত দেশে তো নেই, প্রতিবেশী ভারতেও নেই।

ব্যাংকগুলো দাবি করছে, ন্যূনতম বেতন-ভাতা কার্যকর করতে হলে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ বেড়ে যাবে। এতে কমবে ব্যাংকের মুনাফা। এর কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করার উদ্যোগও থমকে যাবে। আর মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী না করতে পারলে ব্যাংকগুলো পড়বে ঝুঁকিতে।

ব্যাংকারদের চাকরির সুরক্ষা, বেতন-ভাতা নির্ধারণ নিশ্চয়ই একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধন্যবাদ পাওয়া যোগ্য। তবে তা হতে হবে যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামগ্রিক প্রভাবও ভেবে দেখা উচিত।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি খরচ হয় কর্মীদের বেতন-ভাতায়। তবে এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) বেতন যুক্ত নয়। এমডিরা যে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নেন, তা নতুন কর্মীদের চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ব্যাংকের পরিচালন খরচের মধ্যে বেতনের বাইরে বড় খরচ হয় ভাড়া ও বিভিন্ন পরিষেবা বিলে। নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংকের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা।

ব্যাংকারদের চাকরির সুরক্ষা, বেতন-ভাতা নির্ধারণ নিশ্চয়ই একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধন্যবাদ পাওয়া যোগ্য। তবে তা হতে হবে যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামগ্রিক প্রভাবও ভেবে দেখা উচিত। তাহলেই তা টেকসই হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না, যা বারবার বদল করতে হয়।

এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও আসলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এরপর গত বছরের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহারও নির্ধারণ করে দেয়। এরও কোনো নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এতেই যেন স্বস্তির ঢেকুর তুলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা নির্ধারণের মতো জনপ্রিয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি অর্থ পাচার, ব্যাংক দখল ও বেনামি ঋণ ঠেকানো এবং কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নিত, তাহলে আমানতকারীদের পাশাপাশি পুরো দেশ উপকৃত হতো। আর ব্যাংকাররাও থাকত স্বস্তিতে। যেমন স্বস্তি এসেছে ব্যাংকারদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ ও চাকরির সুরক্ষার উদ্যোগে।

সাংবাদিক, প্রথম আলো
shanaullah.sakib@prothomalo.com