পিপিআরসি–বিআইজিডি সমীক্ষা

সহায়তা পেয়েছে ৩৯% পরিবার

  • ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, মানুষের খাপ খাওয়ানোর অসাধারণ সক্ষমতা বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়েরই একটি দিক। মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

  • শহরাঞ্চলের বস্তির মানুষের খাদ্য ব্যয় কমেছে ২৭ শতাংশ।

  • গ্রামের বস্তির ক্ষেত্রে তা ২১ শতাংশ।

কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের গরিব মানুষের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা অসাধারণ—এটাকেও উন্নয়ন বিস্ময় হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে এ দেশের মানুষ। এবারও পারবে।

গতকাল পিপিআরসি ও বিআইজিডির এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

মানুষের খাপ খাওয়ানোর অসাধারণ সক্ষমতা বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়েরই একটি দিক। কোভিডের ধাক্কায় জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিক, কিন্তু সবকিছু আবার যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, মানুষের খাপ খাওয়ানোর অসাধারণ সক্ষমতা বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়েরই একটি দিক। কোভিডের ধাক্কায় জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিক, কিন্তু সবকিছু আবার যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মহামারিতে মৃত্যুহার কম হওয়া এর একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি। প্রতিবেদনে কিছু হতাশার কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। এই খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়, সে জন্য ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, এই খাতকে যেভাবে সহায়তা করা হবে এবং যতটা চলতি পুঁজি সরবরাহ করা হবে, তার ওপর অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করবে। অন্যদিকে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখন যথেষ্ট বহুমুখী। কৃষি এখনো বড় খাত হলেও কর্মসংস্থানে অকৃষি খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে। সে জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের পুনরুজ্জীবন সবচেয়ে জরুরি বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

পিপিআরসি ও বিআইজিডির প্রতিবেদনে যে মানুষের স্বাস্থ্যগত অরক্ষিত অবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

পাশাপাশি এই মহামারি স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে নতুন চিন্তার অবকাশ তৈরি করেছে বলে মনে করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পিপিআরসি ও বিআইজিডির প্রতিবেদনে যে মানুষের স্বাস্থ্যগত অরক্ষিত অবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সমীক্ষা প্রতিবেদন পেশ করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন। তাঁরা জানান, মহামারির মধ্যে একদিকে মানুষকে সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে, অন্যদিকে খাদ্য গ্রহণ কমাতে হয়েছে। তাঁরা দেখেছেন, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে ৩৯ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা পেয়েছে। তবে এই সহায়তা হারানো উপার্জনের খুবই সামান্য—৪ শতাংশ।

মানুষকে নানাভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে। কোভিড-১৯ সংকটের সময় জীবিকা, খাপ খাওয়ানো, পুনরুদ্ধার শীর্ষক এই সমীক্ষার তথ্যমতে, শহরাঞ্চলের বস্তির মানুষের খাদ্য ব্যয় কমাতে হয়েছে ২৭ শতাংশ এবং গ্রামের বস্তির ক্ষেত্রে তা ২১ শতাংশ। এই পরিস্থিতি এপ্রিলের পর জুন মাসেও তেমন একটা বদলায়নি। খাদ্য ব্যয় কমানোর মারাত্মক পরিণতি হতে পারে বলে সতর্ক করেন ইমরান মতিন; বিশেষ করে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে।

সংকটের শুরুর দিকে যেখানে মানুষকে সঞ্চয় ভেঙে খেতে হয়েছে, সেখানে পরের দিকে ঋণনির্ভর হতে হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নারী-পুরুষ
বৈষম্য। শ্রমঘন শিল্পের নারী শ্রমিকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এই পরিস্থিতি সবার জন্যই নতুন। তা সত্ত্বেও সরকার শহরের বস্তির মানুষকে নানাভাবে ত্রাণসহায়তা করেছে। সমন্বিতভাবে সরকার নীতিগত ব্যবস্থা নিয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম

তবে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গ্রামীণ পরিবারের তুলনায় শহুরে পরিবার অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে জন্য শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। অন্যদিকে চরম দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে অভিবাসনের আগ্রহ কম। তাদের যাওয়ার বিশেষ জায়গাও যেমন নেই, তেমনি যাওয়ার জন্যও খরচ লাগে। সে জন্য এই পরিবারগুলো তেমন একটা অভিবাসন করেনি। মূলত নতুন দরিদ্র মানুষেরাই অভিবাসন করেছে। কিন্তু অভিবাসনের কারণে এই মানুষদের জীবন যেমন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে, তেমনি শ্রমবাজার হয়েছে আরও অনানুষ্ঠানিক।

শহরের দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এই পরিস্থিতি সবার জন্যই নতুন। তা সত্ত্বেও সরকার শহরের বস্তির মানুষকে নানাভাবে ত্রাণসহায়তা করেছে। সমন্বিতভাবে সরকার নীতিগত ব্যবস্থা নিয়েছে। সংকটের শুরু থেকেই সরকার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।

মহামারির কারণে ব্যক্তিগত পরিসরে যেমন নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও প্রণোদনার সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তৃণমূলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সব কাগজপত্র থাকে না, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা এই ক্ষেত্রে আরও বেশি পিছিয়ে আছেন। সে জন্য তাঁদের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এই মহামারির মধ্য দিয়ে বিশ্বায়নব্যবস্থার দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে। সময় এসেছে এখন স্থানীয় অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়ার। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ ও শিক্ষাদান পদ্ধতি উন্নত করার ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। আর এই সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি, বিশেষ করে আরবান প্রাইমারি (শহরের প্রাথমিক) শিক্ষা প্রকল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে বলে তিনি মনে করেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে তিনি এটি প্রস্তাব হিসেবে পেশ করেন।

মহামারি যেমন ধাক্কা দিয়েছে, তেমনি বড় পরিবর্তনের সুযোগও এনে দিয়েছে বলে মনে করেন বক্তারা। সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁরা বলেন, নগদ সহায়তা কাজে এসেছে। তবে এখন এই ব্যবস্থার ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে বলে তাঁদের মত।