>সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম একসময় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেরও (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ছিলেন। শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও ব্যাংক খাত নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম।
প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
মির্জ্জা আজিজুল: নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কারণও আছে। বাজারের এই দশার জন্য অন্যতম দায়ী ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য–সংকট আছে। ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি নিয়েও মানুষ সন্দিহান। ফলে ব্যাংকের শেয়ারের পতন হয়েছে। আমরা জানি যে আমাদের শেয়ারবাজারের বড় অংশজুড়েই রয়েছে ব্যাংক খাত। স্বাভাবিক কারণেই বাজারের সার্বিক সূচকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
প্রথম আলো: কিন্তু খেলাপি ঋণ ও তারল্য–সংকটের সঙ্গে শেয়ারবাজারের পতনের কী সম্পর্ক?
মির্জ্জা আজিজুল: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সন্দেহজনক ঋণ হিসাব (এসএমএ), অবলোপন ও আদালতে মামলা থাকার কারণে আটকে থাকা টাকার উল্লেখ নেই। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে হিসাব করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হবে। যেমন, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ২ শতাংশ এককালীন নগদ জমা ও ১০ বছরে বাকি ঋণ পরিশোধের সুযোগ তৈরির উদ্যোগের কারণে ব্যাংক খাতে নৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, ভালো গ্রাহকেরা ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ২ থেকে ৩ বছরে পরিশোধ করে আসছিলেন, তাঁদেরও যেন খেলাপি হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর পুরো ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে সুশাসনের ঘাটতি তো আছেই। সুতরাং এর একটি নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে থাকবে না?
প্রথম আলো: আর কোনো কারণ নেই?
মির্জ্জা আজিজুল: আছে। এখানেও ব্যাংক খাতই সামনে চলে আসে। যেমন অনেক বিনিয়োগকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু তারল্য–সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজার খারাপ হওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে গ্রামীণফোনের বাগ্বিতণ্ডাও একটি বড় কারণ। এর সুরাহা এখনো হয়নি। বাজারে বড় আকারে পতন হওয়ার সঙ্গে এ বিষয়টিরও যোগসূত্র রয়েছে।
প্রথম আলো: বিনিয়োগকারীদের দিক থেকে যদি বিবেচনা করেন?
মির্জ্জা আজিজুল: হ্যাঁ। তাঁদেরও দায় আছে। বিনিয়োগকারীরা অযৌক্তিক আশঙ্কায় ভোগেন। এখানকার বিনিয়োগকারীদের হুজুগে মেতে ওঠার প্রবণতা খুব বেশি। কিছু সমস্যা বাড়লেও মোটা দাগে সমস্যাগুলো নতুন নয়। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ার আছে এখনো, যাদের মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) বিনিয়োগযোগ্য। কিন্তু তাঁরা সে পথে না গিয়ে অহেতুক আশঙ্কা করতে থাকেন।
প্রথম আলো: কিন্তু বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কি আছে?
মির্জ্জা আজিজুল: বাজারে যে হারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে, তা অবশ্য আস্থাহীনতারই সুস্পষ্ট প্রমাণ।
প্রথম আলো: আস্থাহীনতা দূর করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না?
মির্জ্জা আজিজুল: বিএসইসির কাজ হচ্ছে ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধের পাশাপাশি লেনদেনে অনিয়ম হলে তা দূর করা। বিএসইসি শেয়ারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবে অনেক সুগঠিত বাজারেও বড় পতন হয়। বিনিয়োগকারীদের আচরণেরও পরিবর্তন দরকার।
প্রথম আলো: বিনিয়োগকারীদের আচরণে কী ধরনের পরিবর্তনের কথা বলছেন?
মির্জ্জা আজিজুল: এখানকার বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কৌশলেই ভুল আছে। সঞ্চয় বা বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পুরোটাই যে শেয়ারবাজারে খাটাতে হয় না, এটা মনে হয় তাঁরা জানেন না। খাটাতে হয় মোট তহবিলের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। এদিকে অনেক বিনিয়োগকারীকে দেখা যায় আজ শেয়ার কিনে দুই দিন পরে বিক্রি করে দিতে চান। শেয়ার কিনে তা ধরে রাখতে হবে। ধরে রাখলে একসময় লভ্যাংশ পাওয়া যাবে অথবা মূলধনি মুনাফা (ক্যাপিটাল গেইন) অর্জন করা যাবে। আমার একটা গবেষণায় উঠে এসেছে যে লম্বা সময় ধরে রাখলে যেকোনো বিনিয়োগের চেয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগই বেশি মুনাফা দেয়।
প্রথম আলো: ২০১০ সালের ধসের পর স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা) হয়েছে, বিধিবিধান পরিবর্তন হয়েছে, মাঝখানে চীন থেকে কৌশলগত বিনিয়োগকারীও নেওয়া হয়েছে। এগুলোর কোনো ইতিবাচক প্রভাব থাকবে না বাজারে?
মির্জ্জা আজিজুল: ইতিবাচক প্রভাব সূচকে আসেনি। আইনি কাঠামোতে এসেছে হয়তো। কৌশলগত বিনিয়োগকারী নেওয়ার সময় ভাবা হয়েছিল বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। সেটা তো হয়ইনি, উল্টো কমেছে। বাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির জন্য বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াও আরেকটা কারণ।
প্রথম আলো: বাজারের সব পক্ষকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেশ কয়েকটা বৈঠক করেছেন। এর কোনো ফল দেখা যায়নি। আরেকটা বৈঠক হওয়ার কথা ২০ জানুয়ারি।
মির্জ্জা আজিজুল: সবার আগে দরকার ব্যাংক খাতের উন্নতি। বৈঠক করলে লাভ হবে না। কাজের কাজটি করতে হবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চার থেকে পাঁচ বছর আগে ২৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাজারে তালিকাভুক্ত করতে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁকে তখন বলেছিলাম, শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না, অনবরত চাপ তৈরি করতে হবে। নইলে এরা আসবে না। আসেনি। নতুন করে কোনো বহুজাতিক কোম্পানিও বাজারে আসেনি। দেশি কোনো ভালো কোম্পানিও আসেনি। এসেছে ছোট ছোট কোম্পানি। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারে না আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে যত দূর সম্ভব জবাবদিহির বাইরে থাকা।
প্রথম আলো: উন্নত দেশের চর্চা হচ্ছে বেশি পরিমাণে ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়নের জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পরিবর্তে শেয়ারবাজারের কথা ভাবেন। আমাদের এখানে এ চিন্তা আসবে কবে?
মির্জ্জা আজিজুল: আসবে। আসতেই হবে। এমন সময় বেশি দূরে নয়, ব্যাংক যখন শুধু চলতি মূলধন দেবে। উদ্যোক্তাদের দিক থেকে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তোলা হচ্ছে ঝুঁকি নিরপেক্ষ থাকা। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানি করলে কোম্পানির লাভ হলেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে হবে, লোকসান হলেও করতে হবে। ব্যাংকের ওপর চাপ কমাতে এবং পুঁজিবাজারকে উজ্জীবিত করতে সরকার বাধ্যতামূলক তালিকাভুক্তির কথা বিবেচনা করতে পারে।
প্রথম আলো: সরকার তা করবে বলে আপনার বিশ্বাস?
মির্জ্জা আজিজুল: আমি বিশ্বাস করতে চাই। সব পক্ষকে নিয়ে সরকার বসুক এবং এ ব্যাপারে কার্যকর চিন্তা করুক। বহির্বিশ্বের কথা যদি বাদও দিই, বাজার মূলধন ও কোম্পানির সংখ্যার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই বাংলাদেশ এখনো দুর্বল। তাই আমি আশাবাদী। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই একটা উজ্জ্বল রশ্মি দেখতে পাব বলে আমি বিশ্বাস করি।