যে সাত কারণে ইভ্যালি ধ্বংসের মুখে

পিয়েত্রো জিওভানি গুজলিয়েলমো টেবালদো পঞ্জি
পিয়েত্রো জিওভানি গুজলিয়েলমো টেবালদো পঞ্জি

চার্লস পঞ্জির পুরো নাম পিয়েত্রো জিওভানি গুজলিয়েলমো তেবালদো পঞ্জি। ‘ফিন্যান্সিয়াল জিনিয়াস’ এই চার্লস পঞ্জিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। বিশেষ করে লোভ দেখিয়ে আর্থিক জালিয়াতির যেকোনো ঘটনাকেই এখন অনায়াসে পঞ্জি বা পুঞ্জি স্কিম নাম দেওয়া যায়।

চার্লস পঞ্জির জন্ম ১৮৮২ সালের ৩ মার্চ, ইতালির লুগোতে। মাত্র আড়াই ডলার পকেটে নিয়ে চার্লস পঞ্জি ১৯০৩ সালের ১৫ নভেম্বর বোস্টনে এসেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পেরে কানাডায় চলে গিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছিলেন ১৯১১ সালে। শুরুতে অবৈধ ইতালিয়ানদের সীমান্ত পার করার কাজ করতেন। এ জন্য দুই মাসের জেলও খাটেন। এরপরই আর্থিক খাতে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেন চার্লস পঞ্জি। মূলত ইন্টারন্যাশনাল রিপ্লাই কুপন (আইআরসি) বা একধরনের ডাক মাশুল দিয়েই তার প্রলোভনের ব্যবসা শুরু হয়েছিল। ঘোষণা দেন যে কেউ তাঁর ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে ৯০ দিনের মধ্যে মূলধন দ্বিগুণ হারে ফেরত দেওয়া হবে। একপর্যায়ে তিনি ‘সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ নামে একটি কোম্পানিও খুলেছিলেন। এ জন্য তিনি অসংখ্য এজেন্ট নিয়োগ দেন। এজেন্টরা বিনিয়োগ আনতে পারলে প্রতি ডলারে আকর্ষণীয় কমিশন দেওয়া হতো। এ সময় মানুষজন সর্বস্ব বিনিয়োগ করেন, এমনকি মুনাফা না তুলে পুনর্বিনিয়োগও করেন।

পঞ্জির এই ব্যবসা আসলে লাভজনক ছিল না। যেহেতু অর্থ আসছিল, তাই কেউ কেউ অর্থ ফেরত পাচ্ছিলেন। ১০ জনের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে একজনকে ফেরত দেওয়ার এই পদ্ধতির মাধ্যমে রাজার হালেই দিন কাটাচ্ছিলেন চার্লস পঞ্জি। তবে কিছু মানুষের মধ্যে সন্দেহ ঢুকে পড়ে। বোস্টন পোস্ট পত্রিকা শুরুতে পক্ষে থাকলেও তারাই আবার পঞ্জির ব্যবসার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সরকারও তদন্ত চালায়। এরপরই শুরু হয় পঞ্জির ব্যবসায় ধস। চার্লস পঞ্জি নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেন। কিন্তু শেষ জীবনটি তাঁর ভালো যায়নি। অর্থকষ্ট তো ছিলই, একসময় অন্ধও হয়ে যান। পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় ১৯৪৯ সালের ১৮ জানুয়ারি মারা যান তিনি।

বাংলাদেশে পঞ্জি ব্যবসা

সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদ (এসডিএস) ও ইসলামিক ট্রেড অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড (আইটিসিএল) ছিল নব্বইয়ের দশকের পঞ্জি ব্যবসা। শুরু হয়েছিল টাঙ্গাইল থেকে। মূলত উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে আইটিসিএল অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালালেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিষিদ্ধ করে ২০০২ সালে এসে। তত দিনে সর্বস্বান্ত হাজার হাজার গ্রাহক। এর প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল হোসেন সিরাজী তখন থেকে পলাতক থাকলেও ধরা পড়েছিলেন ২০১৭ সালে।

আইটিসিএলের পরেই যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) উত্থান। যুবকের নিবন্ধনও নেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে। তারাও নানা প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। ২০০৬ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে যুবকের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যাংকিংসহ নানা প্রতারণার চিত্র। এরপর যুবক বিষয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে একটি কমিশন (প্রথম কমিশন) গঠন করেও তেমন লাভ হয়নি। অর্থ ফেরত পাননি এর গ্রাহকেরা। সর্বশেষ হিসাবে যুবকের ৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩৯ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের পাওনা ছিল ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা।

যুবক যেতে না যেতেই আবির্ভাব ডেসটিনিটির, আরেক পঞ্জি স্কিম। তারা নানা প্রলোভন দেখিয়ে সংগ্রহ করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। তাদের কার্যক্রম অবাধে চলে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এর গ্রাহক ছিল প্রায় ৪০ লাখ। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অর্থ কেউ ফেরত পাননি। বড় বড় এ রকম কিছু প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ইউনিপের মতো আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের নামও জড়িয়ে আছে পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে। এরা সবাই মূলত বহু স্তরের বিপণন বা মাল্টি লেবেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি। পৃথিবীর বহু দেশেই এমএলএম কোম্পানি নিষিদ্ধ।

ইভ্যালি কি পঞ্জি স্কিম

ডেসটিনির বিরুদ্ধে একধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পর দেশে পঞ্জি স্কিম বন্ধ হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। এর মধ্যেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-বড় নানা ধরনের কোম্পানি গড়ে উঠেছে, প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ নিয়ে ভেগেও গেছে। এর মধ্যে পরিবর্তনও ঘটে গেছে অনেক কিছুর। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ফেসবুকের প্রসার মানুষের অনেক পুরোনো অভ্যাস বদলে দিয়েছে। অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে মানুষ। আর এ সময়েই ইভ্যালির আবির্ভাব।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির শুরু ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ডায়াপার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তারপর শুরু করেন ইভ্যালি। আর দুই বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের সবচেয়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। ইভ্যালির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল ই-কমার্সকে শহরের বাইরে গ্রামগঞ্জে নিয়ে যাওয়া।

অতি দ্রুত ইভ্যালির গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির রহস্য কী? মূলত ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করার কাজটিই করেছে ইভ্যালি। এতে মাঝপথের খরচটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়, কম দামেও পণ্য দেওয়া যায়। গ্রাহক বাড়াতে অবশ্য অতিরিক্ত কম দামেই পণ্য বিক্রি করেছে ইভ্যালি। আর এই ‘ডিসকাউন্ট’-এর প্রলোভনই ছিল বিপুলসংখ্যক গ্রাহক তৈরির মূল সূত্র ।

আসলে ইভ্যালির ব্যবসা মডেলটি ছিল ‘মানুষের লোভ’। আর এখানেই ইভ্যালির মিল অন্যান্য পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে। প্রলোভন দেখিয়ে বহু মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অল্প কয়েকজনকে দেওয়ার ব্যবসা আদতে পঞ্জি স্কিমের বেশি কিছু নয়।

যে কারণে ধ্বংসের পথে ইভ্যালি

. মো. রাসেল শুরু থেকেই ব্যবসা মডেল হিসেবে বিশ্বের দুই প্রধান ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজন ও আলিবাবার কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু আদতে তিনি অনুসরণ করেছেন চীনের কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পিনডুয়োডুয়ো। পিনডুয়োডুয়ো মূলত সোশ্যাল কমার্স। সামাজিক মাধ্যমে গ্রুপ তৈরি করে পণ্য বিক্রির মডেলটা তাদেরই।

মো. রাসেল পিনডুয়োডুয়োকে অনুসরণ করেছেন ঠিকই, তবে সেবার মান বৃদ্ধি বা গ্রাহক সন্তুষ্টির দিকে কোনো নজর ছিল না। বরং পুরো আগ্রহ ছিল যেনতেনভাবে গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর দিকে। এ জন্য ‘ডিসকাউন্ট’–এর নামে নানা প্রলোভন দেখান তিনি। এতে বিপুলসংখ্যক গ্রাহক পেলেও তাদের সামলানোর রীতি তিনি কখনোই চর্চা করেননি। আদতে মো. রাসেলের ইভ্যালি ছিল এমএলএম পদ্ধতিরই আরেক রূপ, ঠিক যেন যুবক-ডেসটিনির ‘ই-কমার্স সংস্করণ’।

২. চীনের উদ্যোক্তা কলিন হুয়াং পিনডুয়োডুয়ো প্রতিষ্ঠার আগে তথ্য প্রযুক্তি, সামাজিক মাধ্যম ও ই-কমার্স বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করে তারপরই এ ব্যবসায় এসেছিলেন। পিনডুয়োডুয়ো প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। এর আগে চার সিরিজের বিনিয়োগ পায় প্রতিষ্ঠানটি। পরপর চার সিরিজ বিনিয়োগ পাওয়ার পর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও ছাড়ার কাজটি সহজ নয়। পিনডুয়োডুয়োর পক্ষে কাজটি সহজ হয়েছে। কারণ, তাদের হিসাবপত্রে কোনো গোঁজামিল ছিল না, হিসাব পদ্ধতি ছিল সহজ ও স্বচ্ছে এবং ব্যবসায়িক মডেল আকর্ষণীয়।

প্রতিষ্ঠিত দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ পেতে হলে ব্যবসায়িক কাঠামো, হিসাবপত্রের স্বচ্ছতা এবং গুডউইল বা সুনাম খুব জরুরি। ঠিক এখানেই ঘাটতি ইভ্যালির। এ কারণেই ৫০ লাখ গ্রাহক, বিপুল অর্ডার, প্রতিষ্ঠিত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পণ্য বিক্রির চুক্তি থাকলেও কোনো বিনিয়োগকারী খুঁজে পায়নি ইভ্যালি। সুতরাং মো. রাসেলের আক্রমণাত্মক ব্যবসায়িক পদ্ধতির পেছনে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাকে প্রধান কারণ বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের যুক্তি বেশ দুর্বল। এই পথে কখনোই কোনো ভালো বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসবেন না। এমনকি সঠিক নিরীক্ষা না থাকায় বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছে যমুনার মতো গ্রুপও।

. ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরে কাজ শুরুর পরের প্রায় দুই বছর নির্বিঘ্নে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে ইভ্যালি। তবে এর মধ্যেই গ্রাহক অসন্তোষও পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। মো. রাসেল নিয়মিত ফেসবুক লাইভে আসতেন। সে সময় পণ্য না পাওয়ার অসংখ্য মন্তব্য আসত। অবিশ্বাস্য কম দামে পণ্য বিক্রি নিয়েও সন্দেহ বাড়ছিল বিভিন্ন মহলে। আবার নাটক, সিনেমা, খেলাসহ এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিল না, যেখানে ইভ্যালির আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। এ সময় ইভ্যালির ব্যবসায়িক পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে গণমাধ্যমেও আলোচনা শুরু হয়। তবে নানা অনুষ্ঠান পৃষ্ঠপোষক হয়ে কিছু ব্যক্তিকে খুশি রাখার এই পদ্ধতিও আরেক পঞ্জি কোম্পানি ডেসটিনির কাছ থেকেই শেখা।

২০২০ সালের ২৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ইভ্যালি’। এরপরই যুগ্ম সচিব আবদুছ সামাদ আল আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ২৭ আগস্ট ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মো. রাসেলের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

কিন্তু তখনও ইভ্যালি সতর্ক না হয়ে উল্টো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের কাছে ধরনা দেয়। তাতে প্রাথমিকভাবে সফলও হয়। এর এক মাস পরে বিএফআইইউ ইভ্যালির জব্দ করা ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) ইভ্যালি নিয়ে জানতে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করলেও তাদের দেওয়া প্রতিবেদনও আড়ালে চলে যায়। এ সময় মো. রাসেল কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দিয়ে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন। অথচ তখন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না নিয়ে ব্যবসা ঠিকঠাক চালানোর দিকে নজর দিলে বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো এড়াতে পারত ইভ্যালি।

র‍্যাবের অভিযানের সময় নিজ বাসায় ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

. ব্যবসা বাড়াতে সুনাম বাড়ানো বা ধরে রাখা একটি অপরিহার্য উপাদান। গ্রাহক অসন্তোষ সব সময়ই সুনাম নষ্ট করে দেয়। ইভ্যালি সুনাম উদ্ধারে এ সময় ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। তাহসান ও মিথিলার মতো তারকাদের ‘ফেস অব ইভ্যালি’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) তৈরি সিনেমায় আর্থিক সহায়তা করে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষক হয়, সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও টাকা ঢালতে থাকে। ইক্যাবের নানা অনুষ্ঠানেরও পৃষ্ঠপোষক হয় তারা। মন্ত্রীদের নিয়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে ইভ্যালি। সব মিলিয়ে গ্রাহক ছাড়া অন্য সব মহলকে খুশি রাখার এসব কর্মকাণ্ডে অনেক বেশি অর্থ খরচ করেছে তারা। এতে আরও গ্রাহক এসেছে ঠিকই, তাতে বিপদও বেড়েছে। কেননা, আয় বা মুনাফা থেকে এই অর্থ ব্যয় করা হয়নি। গ্রাহকেরা পণ্য কিনতে অর্থ দিয়েছেন, আর সেই অর্থই ব্যয় হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পথে।

. দায় আছে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থারও। ২০২০ সালের আগস্টে একাধিক কমিটি গঠন করেও ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আবার এক মাসের মধ্যে জব্দ করা ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার বার্তাটিও ছিল পরিষ্কার। ছাড় না দিয়ে তখন নিয়মতান্ত্রিক পথে ইভ্যালিকে নিয়ে যেতে পারলে সব মহলই উপকৃত হতো। মাত্র এক কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি যখন গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা নেয়, তখন এর বিপজ্জনক দিকটি আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসা উচিত ছিল।

২০২০ সালের ২৪ আগস্ট প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া সংবাদে কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম বলেছিলেন, ‘ইভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ইভ্যালিও তা-ই করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দেখতে পারে।’ এই উপদেশটি শুনলে তখনই অনেক সমস্যার সমাধান করা যেত।

ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল (বাঁয়ে) ও তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে (ডান থেকে দ্বিতীয়) গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

. যেকোনো ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নগদ অর্থপ্রবাহের। ক্যাশ ফ্লো বা নগদ অর্থপ্রবাহে টান পড়লে সেই কোম্পানি আর এগিয়ে যেতে পারে না। ইভ্যালির সমস্যা এখানেই। গ্রাহকদের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয় করার কারণেই মো. রাসেলের হাতে তেমন অর্থ নেই। এতে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করতে পারছিল না ইভ্যালি। এ কারণেই হয়তো মো. রাসেল শেষ দিকে বারবার নতুন বিনিয়োগ পাওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু তখন অনেক কিছুই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল।

. ইভ্যালি অনেকের জন্য পথপ্রদর্শক। তাদের ব্যবসায়িক পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি হয়েছে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জশপ-এর মতো নানা প্রতিষ্ঠান। প্রলোভনে পড়া গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করার মডেলটি শিখেছে তারা ইভ্যালির কাছ থেকেই। প্রলোভনের এই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে।এতে ইভ্যালির প্রতি নজর চলে যায় সব মহলের। ই-কমার্সের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দেওয়ার দায় ইভ্যালিরই।

শেষ কথা

প্রশ্ন হচ্ছে ইভ্যালি কি ধ্বংস হয়ে গেছে? প্রতিষ্ঠানটিকে কি বাঁচানো সম্ভব? এ জন্য কি মো. রাসেল অপরিহার্য? আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখা কি সম্ভব? অর্থ কি ফেরত পাবে গ্রাহকেরা?

সন্দেহ নেই ইভ্যালি টিকিয়ে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ লাগবে। আর এ জন্য নতুন বিনিয়োগের বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই বিনিয়োগ কে করবে। বিনিয়োগের জন্য সবার আগে প্রয়োজন ইভ্যালির সঠিক নিরীক্ষা বা অডিট। এর প্রকৃত দায়দেনা কত তার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু। দায় বেশি হলে বিনিয়োগকারী পাওয়া কঠিন হবে। দায়দেনা অনেক বেশি হলে ধরে নেওয়া যাবে টাকার অপব্যবহার হয়েছে অনেক বেশি। সেই অর্থ কোথায় কোথায় গেছে সেটি জানাও জরুরি। সুতরাং সঠিকভাবে নিরীক্ষার পরই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপরেই বলা সম্ভব ইভ্যালির ভবিষ্যৎ। তবে বলাই যায় যে অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই ইভ্যালির গ্রাহকদের পক্ষে নয়।