বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে প্রাণ যাবে উলুখাগড়াদেরও

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ এবং এ থেকে সৃষ্ট বৈশ্বিক উদ্বেগ এখন প্রকাশ-বাহুল্যে জীর্ণ। তাই বলে উদ্বেগটি কিন্তু দূরে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না বা রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজও নয়। কারণ, বাণিজ্যযুদ্ধের ধকল সইতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকেই। এই দুই দেশ যতই বিষয়টিকে নিয়ে ‘থোড়াই কেয়ার’ ভাব নিক না কেন, এর মূল্য পুরো বিশ্বকেই চোকাতে হচ্ছে। বিশ্বের বড় দুই বাণিজ্যশক্তি দ্বন্দ্বে জড়ালে তার রেশ সবার গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। কিন্তু তাতে অন্তত বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করা ওয়াশিংটনের কিছু যায়-আসছে না; অন্তত মার্কিন প্রেসিডেন্টের তো নয়ই।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৫ অক্টোবরই নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, সর্বশেষ আলোচনায় চীনকে পর্যুদস্ত করা গেছে। বিরাট বিজয় অর্জিত হয়েছে। কারণ, মার্কিনপক্ষের প্রস্তাব নাকি ছিল চীন যদি কয়েক শ কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য কিনতে রাজি থাকে, তবে চীনা পণ্যে আর কোনো শুল্কারোপ করা হবে না। কথা হচ্ছে, কত শ কোটি ডলার? ট্রাম্পের ভাষ্য, ‘সংখ্যাটি অনেক বড়। আমি বলেছি ৭০ (৭ হাজার কোটি), আমার লোকেরা বলেছে ২০ (২ হাজার কোটি)।’ তারপর তিনি জানিয়ে দেন যে পাঁচ হাজার কোটির নিচে ছাড় দেননি তিনি।

এই ভাষ্যের অর্থটি বুঝতে বেগ পাওয়ার কথা নয়—কোনো সমঝোতা হচ্ছে না। হওয়ার কথা নয়। কারণ, অঙ্কটি অনেক বড়। এত বড় অঙ্কের অর্থে শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির অর্থ হচ্ছে, চীনকে তার অন্য বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে বেজার করতে হবে। একই সঙ্গে এই বিপুল আমদানিতে রাজি হলেও তা চীনের চাওয়ার সঙ্গে মেলে না। কারণ, চীন নতুন কোনো শুল্কারোপ তো নয়ই, চায় বিদ্যমানটিই তুলে নেওয়া হোক। ফলে, এ প্রস্তাব তাদের প্রাথমিক চাওয়ার সঙ্গেই মেলে না। তাই এমন কোনো সমঝোতার প্রস্তাব লিখিত হওয়ার আগেই কেচে যাওয়ার কথা; সই তো দূর অস্ত। অথচ প্রস্তাবটি ভালো হলে আগামী মাসে সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠেয় এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরামে তা সই হতে পারত।

ফলে, খুব শিগগির বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিদ্যমান অস্থিরতা নিরসনের তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ–সম্পর্কিত বিশ্লেষণে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বৈশ্বিক অর্থনীতি বর্তমানে একধরনের সংশয় বিরাজ করছে। বাণিজ্যযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব তাই বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যনীতি অনিশ্চয়তা দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এটি একধরনের স্থবিরতার সৃষ্টি করছে অর্থনীতিতে, যার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে প্রবৃদ্ধিতে।

চলতি সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তার বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস পুনর্মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছর যেখানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, এ বছর তা ৩ শতাংশে নেমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রবৃদ্ধির গতি আরও ধীর হবে। গত জুলাইয়ের আগে প্রকাশিত পূর্বাভাসের চেয়ে এটি অনেক কম হবে। ২০২০ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। চলমান অস্থিরতার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগবে হংকং। গত এপ্রিলে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ বলা হলেও নতুন পূর্বাভাসে তা কমিয়ে দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে। শুধু এ অংশই নয়, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও এর ধাক্কা এসে লাগবে। দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বদলে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

হংকংয়ে চলমান সংকটের গুরুত্ব বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যধিক। কারণ, এটি যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে নানা চিহ্ন দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে শুরু করেছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনের দিকে নজর রাখা ও তা লঙ্ঘনে চীনের ভূমিকা মূল্যায়ন–সম্পর্কিত প্রস্তাব পাস হওয়া অন্তত তারই ইঙ্গিত। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন কংগ্রেসের এমন পদক্ষেপ ক্ষুব্ধ করেছে চীনকে।

বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে মোটাদাগে গোটা বিশ্বই আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বগ্রামে কেউই তো আর বিচ্ছিন্ন নয়। ফলে, বাজারে বিদ্যমান অস্থিরতা সরাসরি প্রভাব ফেলছে উৎপাদন খাতে। উৎপাদনমুখী কারখানাগুলো সাবধানী হয়ে উঠেছে। খুব কম প্রতিষ্ঠানই দীর্ঘ মেয়াদের জন্য যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম ক্রয়ে আগ্রহী। একই সঙ্গে এ অস্থিরতা বিনিয়োগের রাশ টেনে ধরেছে। বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি এর ধরনের কারণেই তা অর্থনীতিতে খুব একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারছে না। কারণ, এই সময়ে অধিকাংশ বিনিয়োগই হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাকে হাতে নিয়ে। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে পুঁজিবাজার ঘিরে। বিদ্যমান অনিশ্চয়তায় পুঁজিবাজার সুতার ওপর দিয়ে হাঁটছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। যেকোনো ঘটনা, এমনকি দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তিতে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। এই সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দশমিক ৮ শতাংশ ও চীনের জিডিপি ২ শতাংশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুদ্রামানে এই শতাংশ আদতে কত?

আইএমএফের কথা সত্যি হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সাড়ে ১২ হাজার কোটি ডলার। আর চীনের ক্ষেত্রে ৩০ হাজার কোটি ডলার। নিঃসন্দেহে অনেক বড় সংখ্যা। এর ভুক্তভোগীর সংখ্যা সম্ভবত তার চেয়েও বড়, যা নিয়ে উদাসীন খেলা কখনোই উচিত নয়। এই ঔচিত্যের কথা কি খামখেয়ালি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কানে পৌঁছাবে, যিনি ‘গ্রেট’ এবং ‘উইন’ ছাড়া কিছুই বুঝতে চান না?