>• আইএমএফের প্রতিবেদন
• দুর্নীতি সবচেয়ে ক্ষতি করে অর্থনীতির
• প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার
• মানুষ কর দিতে আগ্রহী হয় না
• অর্থের অপচয় করে দ্বিগুণ
• বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এক-তৃতীয়াংশ কম
একই ধরনের অর্থনীতির দুটি দেশ। একটি দেশ অন্যটির তুলনায় দুর্নীতি কমাতে পারলে মোট জিডিপির হিসাবে ৪ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারবে। কেননা, যত বেশি দুর্নীতি, তত কম কর আদায় হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বের ১৮০টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য দিয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। চলতি মাসে এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক এই সংস্থা আরও বলেছে, পৃথিবীতে দুর্নীতিমুক্ত দেশ বলতে কিছু নেই। কোথাও বেশি, কোথাও কম। তবে যে দেশ যত বেশি দুর্নীতি কমাতে পারবে, দেশটির জনগণ তত বেশি উপকৃত হবে।
প্রতিবেদনের শুরুতেই আইএমএফ বলেছে, ব্যক্তিগত লাভের আশায় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার সরকারের ওপরেই বিশ্বাস নষ্ট করে, এতে সরকারের নীতির কার্যকারিতা কমে যায় এবং করদাতাদের দেওয়া অর্থ স্কুল, হাসপাতাল ও রাস্তা থেকে অন্যত্র চলে যায়। আর এই যে অর্থের অপব্যবহার, তার মূল্য অনেক বেশি। কেননা, অর্থের সঠিক ব্যবহার অর্থনীতিকে আরও ভালো করে। তবে এ জন্য শক্তিশালী ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি এবং এ জন্য দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
অর্থ নষ্ট করে দুর্নীতি
প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, উচ্চ দুর্নীতি কর আদায় কমিয়ে দেয়। কারণ, মানুষ তখন কর ফাঁকি দিতে ঘুষ দেয়। মানুষ যখন জানে সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত, তখন তারা কর দিতেও আগ্রহী হয় না। আবার সরকারি কর্মকর্তারাও মনে করে, সবাই যেহেতু ঘুষ খায়, সে–ও নিতে পারে। এসব দেশে সরকারও অনেক সময় প্রভাবশালীদের জন্য নানা কর ছাড় দেয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে দেশে দুর্নীতি কম, সে দেশে সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পের অর্থের অপচয়ও কম। দুর্নীতিগ্রস্ত উঠতি অর্থনীতির একটি দেশ অন্য দেশের তুলনায় অর্থের অপচয়ও দ্বিগুণ বেশি করে। দুইভাবে সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়। যেমন প্রাক্কলনের তুলনায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় এবং সরকারি কেনাকাটায় দরপত্রের জালিয়াতি করে কাজ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতি একটি দেশের সরকারের অগ্রাধিকারও নষ্ট করে দেয়। যেমন দেখা গেছে বেশি দুর্নীতির একটি দেশের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এক-তৃতীয়াংশ কম থাকে। আবার সামাজিক খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার কার্যকারিতাও কম হয়। যেমন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায়ও কম নম্বর পায়, শিক্ষক ও চিকিৎসকেরা অনুপস্থিত থাকেন। আবার বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করে এমন রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির প্রভাব অত্যন্ত খারাপ। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অনেক কম দক্ষ। প্রাকৃতিক সম্পদ আছে এমন দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেরও দক্ষতা কম হয়। এসব দেশের দুর্নীতিও প্রকট।
তাহলে কী করতে হবে
আইএমএফ মনে করে, দুর্নীতি কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে জরুরি। কেননা, দুর্নীতি রোধ করতে হলে একটি শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। এভাবে কিছু দেশ দুর্নীতি কমাতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ তিনটি দেশের উদাহরণ দিয়েছে। যেমন কলম্বিয়া, কোস্টারিকা ও প্যারাগুয়ে এমন একটি অনলাইন কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে সব সরকারি প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতির বিবরণ দেওয়া থাকে। সাধারণ নাগরিক তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তবে আইএমএফ মনে করে, মুক্ত গণমাধ্যম হচ্ছে সরকারি প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এ ছাড়া, জনপ্রশাসনে বড় ধরনের সংস্কার এবং সরকারের কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় বা ডিজিটালাইজেশন দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে কি হয়
প্রতিবেদনে দুর্নীতি কমাতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে এমন কিছু দেশের উদাহরণ দেওয়া আছে। তবে বাংলাদেশের নাম নেই। পরিসংখ্যান অংশে অবশ্য বাংলাদেশ প্রসঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর কর-জিডিপি হারের একটি তালিকা দেওয়া আছে। আর সেই তালিকা হচ্ছে যত বেশি দুর্নীতি, তত কম কর আদায়ের একটি বড় উদাহরণ।
তালিকা অনুযায়ী, স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায়, ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপরেই আছে বাংলাদেশ, ১০ দশমিক ১ শতাংশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, বাংলাদেশে ৬৮ শতাংশ সামর্থ্যবান মানুষ আয়কর দেন না।
এদিকে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দের দিক থেকেও এশিয়ায় নিচের দিকে আছে বাংলাদেশ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ০৯ শতাংশ ও স্বাস্থ্য খাতে ২ শতাংশ। এ ছাড়া, ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে যে পদ্মা সেতু তৈরির অনুমোদন পেয়েছিল, তা এখন দফায় দফায় বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে আইএমএফের প্রতিবেদনের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মিল আছে বাংলাদেশের।