সাক্ষাৎকার : ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবুল কাসেম খান

ভারতের উন্নতি কীভাবে তা পর্যালোচনা দরকার

আবুল কাসেম খান
আবুল কাসেম খান

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচকটি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? বিনিয়োগকারীরা এটিতে গুরুত্ব দেয় বলে আপনার মনে হয়?

আবুল কাসেম খান: একটি দেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমেই দেখে ডুইং বিজনেসে সংশ্লিষ্ট দেশটির অবস্থান কী? বিশ্বব্যাংক একটি বৈশ্বিক সংস্থা, তাদের কথা সবাই জানে। ফলে তাদের মাপকাঠি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের এ সূচকে উন্নতি করা খুবই জরুরি।

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংক গত মঙ্গলবার রাতে ডুইং বিজনেস সূচক-২০১৮ প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ অবনতি হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

আবুল কাসেম খান: এ ক্ষেত্রে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। আমি হতাশ, আবার হতাশ নই। প্রথমত হতাশ, কারণ আমরা এক ধাপ পিছিয়ে গেছি। আবার হতাশ নই, কারণ সরকার এ ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য একটি লক্ষ্য ঠিক করেছে এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। আপনি যদি এক বছর আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তাহলে আমি আসল প্রতিক্রিয়া জানাতে পারতাম। ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে আমরা ডুইং বিজনেসে উন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। সরকার এদিকে যে মনোযোগ দিয়েছে, তা আগে ছিল না। তাই এ ক্ষেত্রে একটা আশার জায়গা আছে।

প্রথম আলো: ধরেন, বাংলাদেশ ডুইং বিজনেসে উন্নতির জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু সংস্কারের একটা চলমান ধারা তো থাকা উচিত। এ বিবেচনায় কি এক ধাপ পেছানো গ্রহণযোগ্য?

আবুল কাসেম খান: আমিও একটু বিস্মিত। আমরা পেছাব কেন? অনেক দিন ধরেই কিন্তু আমরা ব্যবসা সহযোগী, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের কথা শুনছি। কিন্তু আগেও আমি আপনাকে বলেছি, মাঠে সমস্যা থেকে যায়। সরকারের নীতিনির্ধারক ও একটি মন্ত্রণালয় বা সংস্থার উচ্চপর্যায়ে আমরা ইতিবাচক মনোভাব দেখি। কিন্তু নিচের পর্যায়ে সমস্যা রয়ে যায়। এ জন্য নিচের পর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে তাঁদের দক্ষতা বাড়ে এবং মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। একটি ছোট বিষয় নিয়ে কি বারবার মন্ত্রী বা সচিবদের কাছে যাওয়া যায়। এ ছাড়া আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু নতুন একজন বিনিয়োগকারীর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আমরা গিয়ে বললে আমাদের কাজ হয়ে যায়, কিন্তু ৯৯ শতাংশ লোক কিন্তু সেটা পারছে না।

কর ও বাণিজ্য-সংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অংশীদার হিসেবে নিতে হবে, শুধু একবার আলোচনা নয়। এতে কোনো ত্রুটিপূর্ণ নীতি হলে ব্যবসায়ীরাও দায়ী থাকবেন, তাঁরা সরকারকে দোষী করতে পারবেন না। নীতি তৈরি করছে, যারা ব্যবসায়ের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এ কারণে ভ্রান্ত নীতি হচ্ছে। যা নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। সেটা কিন্তু সিঙ্গাপুরে হচ্ছে না। বাজেটের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একের পর এক বৈঠক করে। কিন্তু কয়টা সুপারিশ গ্রহণ করা হয়? এসব আলোচনা কার্যকর হলে আমরাও কিন্তু কার্যকর সুপারিশ ছাড়া বাকি কোনো সুপারিশ তুলে ধরতাম না।

প্রথম আলো: সরকার প্রায় এক বছর আগে এ উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের সচিবদের নিয়ে হবিগঞ্জের বাহুবলে বৈঠক হয়েছে। এরপর এ কার্যক্রমে গতি আছে বলে আপনি মনে করেন কি?

আবুল কাসেম খান: আমার মনে হয়, প্রতিটি প্রান্তিকে সরকার ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে অগ্রগতি পর্যালোচনার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এ ছাড়া একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি তদারকি বা পর্যবেক্ষণ দল থাকতে পারে। এ ছাড়া পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০টি দেশে আসার লক্ষ্যের পাশাপাশি বছরভিত্তিক একটি লক্ষ্য থাকা উচিত, যা থেকে আমরা বুঝতে পারব, আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি কি না।

প্রথম আলো: এ বছর ডুইং বিজনেস সূচকে ভারত ৩০ ধাপ এগিয়েছে। ১৩০তম অবস্থান থেকে ১০০তম অবস্থানে উঠে এসেছে দেশটি। দেশটির গণমাধ্যম এটি ফলাও করে প্রকাশ করছে। সরকারও বেশ উচ্ছ্বসিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কি কোনো শিক্ষণীয় বিষয় আছে?

আবুল কাসেম খান: আমার মনে হয়, ভারতের এ অগ্রগতি বাংলাদেশের পর্যালোচনা করা উচিত। কোন কোন জায়গায় তারা উন্নতি করল। আমরা চেম্বার থেকেও বিষয়টি পর্যালোচনা করব। ভারত এগিয়ে গেল, এটা নিয়ে কিন্তু তারা ব্যাপক বিপণন করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এই যে বিপণন, এটি দেশের ভাবমূর্তি, বিদেশি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ১ ধাপ না পিছিয়ে ১০ ধাপ এগিয়ে গেলে সেটা নিয়ে আমরা ইতিবাচকভাবে বলতে পারতাম।

প্রথম আলো: এখানে একটা প্রশ্ন এসে যায়, ব্যবসায়ীদের সব দাবি মেনে নিলে কিন্তু রাজস্ব আদায়ে ধস নামবে। নীতি তৈরির ক্ষেত্রে অংশীদার হতে হলে তো রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপায়গুলোও বলে দিতে হয়।

আবুল কাসেম খান: অবশ্যই আমরা সেটা বলে দেব। যারা কর দেয় না, তাদের করের আওতায় আনা ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্ব। এতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতাও নিশ্চিত হবে। তবে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে মানুষ কর দেওয়ার বিপরীতে কী পায়, সেটা বিবেচনা করে।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন রাস্তাঘাটের দুরবস্থা, শিক্ষা-চিকিৎসা ব্যবস্থার নিম্নমান, গণপরিবহন-ব্যবস্থার খারাপ অবস্থা মানুষকে কর প্রদানে অনীহ করে তোলে?

আবুল কাসেম খান: অবশ্যই। যে ব্যক্তিকে রাজধানীতে বাসে ঝুলে ঝুলে যাতায়াত করতে হয়, তিনি কর দিতে চাইবেন না। সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কিন্তু করের টাকার সুষ্ঠু ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করেছে। সেখানে মানুষ কর দেয় এবং তার দৈনন্দিন জীবনে তার সুফল পায়।

প্রথম আলো: আমরা আবার ডুইং বিজনেসে ফিরি। এক দরজায় সব সেবা দেওয়া বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে সরকার আইন করছে। আপনি কি মনে করেন, এতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে?

আবুল কাসেম খান: আমি মনে করি, হওয়া উচিত। আইন হলে একটি বাধ্যবাধকতা চলে আসবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি খুবই জরুরি। আপনি যদি বিডার কথা বলেন, তাহলে আমি বলব, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান খুবই গতিশীল একজন লোক। কিন্তু সংস্থা হিসেবে বিডার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা আছে? সংস্থাগুলোর সক্ষমতা না বাড়লে, শুধু ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করে লাভ হবে না।

প্রথম আলো: বিডা আগামী জুন থেকে অনলাইনে এক দরজায় সেবা দেওয়ার বিষয়টি পরীক্ষামূলকভাবে চালুর চিন্তা করছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

আবুল কাসেম খান: চালু হওয়ার পরে বোঝা যাবে পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে। তবে আমার মনে হয়, একজন বিনিয়োগকারীর অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি কোন পর্যায়ে আছে, সেটা জানার একটা ব্যবস্থা থাকা ভালো। যেমন আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে আমার পার্সেল কোন জায়গায় আছে, সেটা আমি দেখতে পারি।

প্রথম আলো: এ বছর আমাদের পেছানোর কারণ ঋণ পাওয়া, ছোট বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও চুক্তির বাস্তবায়নের দিক দিয়ে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

আবুল কাসেম খান: বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু ছোট ও মাঝারিদের পক্ষে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়েছে। এটাই মনে হয় পেছানোর কারণ। আমরা বলছি, ব্যাংকের জামানতের ধরন পাল্টাতে হবে। বাংলাদেশে বিরোধ নিষ্পত্তি কঠিন এবং খরচও অনেক বেশি।

প্রথম আলো: সম্প্রতি দুটি ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের সঙ্গে ডুইং বিজনেস সূচকের ভিত্তিতে ছোট বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি আপনি যুক্ত করবেন কি না? এ ধরনের ঘটনা কি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দ্বিধাগ্রস্ত করে?

আবুল কাসেম খান: অবশ্যই। এখন সবাই সবকিছু জানে। একটি দেশের করপোরেট সংস্কৃতি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলে। আমি জানি, সিঙ্গাপুরে কী করা যাবে, কী করা যাবে না। তাই আমি সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় যাব। আমি কিন্তু রুয়ান্ডায় যাব না। আমি যদি শুনি, একটি দেশে এটা হচ্ছে, ওটা হচ্ছে, তাহলে আমি কিন্তু সেই দেশে যাব না।