ব্যাংক পরিচালনা করেন কর্মকর্তারা, আর পরিচালকেরা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন। বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেন। মূলত ব্যাংকের বড় সব সিদ্ধান্ত নেন পরিচালকেরা।
সরকারি ব্যাংকের পরিচালক করা হয় সরকার মনোনীত প্রতিনিধিদের। আর বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা ও তাঁদের মনোনীত প্রতিনিধিরা। যদিও ব্যাংক চলে আমানতকারীদের টাকায়। কিন্তু তাঁদের কোনো প্রতিনিধি নেই পর্ষদে। তাই আমানতকারীর স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রাখার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
সরকার যেহেতু কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ না, তাই ব্যাংক পরিচালক হিসেবে মূলত সাবেক ও বর্তমান আমলারাই সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পান। কারণ, আমলারাই নির্ধারণ করেন কারা পরিচালক হবেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য একজন–দুজন সাবেক ব্যাংকার সরকারি ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ পান। আবার ভূমিকা রাখতে গিয়ে তাঁরাই বিপদে পড়েন, বাদ পড়েন পরিচালক পদ থেকে। এর ধারাবাহিকতায় সবশেষ অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে মো. ফরজ আলীকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। তিনি ছিলেন জনতা ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক। ফলে ব্যাংকের স্বার্থে ছিলেন সোচ্চার।
এর আগে ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু হলে তা নিয়ে পর্ষদে সোচ্চার ছিলেন ব্যাংকটির সে সময়কার দুই পরিচালক এ কে এম কামরুল ইসলাম ও এ কে এম রেজাউর রহমান। ব্যাংকের স্বার্থরক্ষায় সোচ্চার হওয়ায় তাঁদেরও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বেসিক ব্যাংক থেকে।
২০১৮ সালেও জনতা ব্যাংক থেকে দুই পরিচালককে সরিয়ে দিয়েছিল সরকার। তাঁরা হলেন তৎকালীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মানিক চন্দ্র দে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল হক। তবে তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাংকে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সরকার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক থেকে একই প্রক্রিয়ায় পরিচালকদের সরিয়ে দেন। ফলে কাকে অনিয়মের দায়ে ও কাকে অনিয়ম রোধ করার উদ্যোগ নেওয়ার কারণে সরানো হচ্ছে, তা আর জানা যায় না।
সরকারি ব্যাংকগুলোতে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নামসর্বস্ব। শুধু চেয়ারম্যান ও এক-দুজন পরিচালক পর্ষদ সভায় সক্রিয় থাকছেন। বাকিরা শুধু উপস্থিত থাকছেন, নিয়মিত সভায় অংশগ্রহণের ভাতা নিচ্ছেন। বিষয়টা এমন, যেন উপস্থিতিই বড় কথা।
আর যাঁরা সক্রিয় থাকছেন, তাঁরাই পড়ছেন বিপদে। কথা বলার কারণে কারও কারও চক্ষুশূল হচ্ছেন। আবার আঘাত লাগছে প্রভাবশালী কারও কারও স্বার্থে। তাই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে প্রভাবশালীরা এসব সোচ্চার পরিচালককে সরিয়ে দিতে বাধ্য করছে সরকারকে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, কোনো প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একটু বিরাগভাজন হলেই মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ পাচ্ছেন না রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের অনেক পরিচালক। যেমনটা ঘটেছে মো. ফরজ আলীর ক্ষেত্রেও। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালকদের সরকার কী বার্তা দিচ্ছে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
সম্প্রতি একটি পোশাক কারখানাকে ঋণ দেওয়া নিয়ে পর্ষদ সভায় দ্বিমত পোষণ করেন ফরজ আলী। প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণের ব্যবস্থা করতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন ব্যাংকটির প্রভাবশালী একজন গ্রাহক। ফরজ আলীর ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হন ওই গ্রাহক।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ও পরিচালনা পর্ষদগুলোকে অধিকতর কার্যকর, দক্ষ ও পেশাভিত্তিক করতে ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংকের পর্ষদগুলোতে অর্থনীতিবিদ; সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ (সিএ); আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি; সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবী থাকবেন।
তবে প্রায় এক যুগ হতে চললেও পর্ষদ সদস্য বা পরিচালক নিয়োগে ওই প্রজ্ঞাপনের কোনো প্রতিফলন নেই। শুরু থেকে এ প্রজ্ঞাপন লঙ্ঘন করে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয় নিজেই। ২০১০ সালে নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ভার বিভাগটিরই।
অগ্রণী ব্যাংকে এমন ঘটনা অবশ্য এটি প্রথম নয়। এর আগে ব্যাংকটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক লীলা রশিদকে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়ার প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে।
ব্যাংকটির একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি একটি পোশাক কারখানাকে ঋণ দেওয়া নিয়ে পর্ষদ সভায় দ্বিমত পোষণ করেন ফরজ আলী। প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণের ব্যবস্থা করতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন ব্যাংকটির প্রভাবশালী একজন গ্রাহক। ফরজ আলীর ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হন ওই গ্রাহক। পরে তিনি ফরজ আলীর বিরুদ্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও গভর্নরের কাছে অভিযোগ করেন ওই প্রভাবশালী গ্রাহকের এক তদবিরকারী।
সরকারি ব্যাংকের পরিচালকেরা পর্ষদের সভায় কী ভূমিকা পালন করবেন। ব্যাংকের স্বার্থ দেখবেন নাকি প্রভাবশালীদের স্বার্থ? নাকি চুপচাপ বসে থেকে শুধু অংশগ্রহণের জন্য ভাতা নিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করবেন। সরকারের নিয়োগ দেওয়া পরিচালক যদি ব্যাংকের স্বার্থ না দেখেন, তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে সরকারের স্বার্থ দেখবেন কারা? এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
অগ্রণী ব্যাংকে এমন ঘটনা অবশ্য এটি প্রথম নয়। এর আগে ব্যাংকটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক লীলা রশিদকে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়ার প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে। পর্যবেক্ষক হিসেবে পর্ষদের একটি সভায় লীলা রশিদ কথা বলার সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জায়েদ বখত তাঁকে থামিয়ে দেন। পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করেন। এ বিষয়ে লীলা রশিদ লিখিতভাবে গভর্নরের কাছে অভিযোগ করেন। পরে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে জায়েদ বখত তৃতীয় মেয়াদে পুনর্নিয়োগ পেলে পর্যবেক্ষক পদ থেকে পদত্যাগ করেন লীলা রশিদ।
যদিও অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম মনে করেন, ‘পরিচালক হিসেবে অভিজ্ঞ ব্যাংকার পেলে যেকোনো ব্যাংক উপকৃত হবে। কারণ, ব্যাংকের কার্যক্রম সবাই বুঝতে পারে না।’
ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি ব্যাংকের পরিচালকেরা পর্ষদের সভায় কী ভূমিকা পালন করবেন। ব্যাংকের স্বার্থ দেখবেন নাকি প্রভাবশালীদের স্বার্থ? নাকি চুপচাপ বসে থেকে শুধু অংশগ্রহণের জন্য ভাতা নিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করবেন। সরকারের নিয়োগ দেওয়া পরিচালক যদি ব্যাংকের স্বার্থ না দেখেন, তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে সরকারের স্বার্থ দেখবেন কারা? এটাই এখন বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সদুত্তর যেমন জরুরি, তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে কোন পরিচালককে কী কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়, তা–ও সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। তাহলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা যেমন স্বস্তি পাবেন, তেমনি গ্রাহকদের কাছেও সঠিক বার্তা পৌঁছাবে।