খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রতিক্রিয়া

ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের জায়গায় বড় ঘাটতি আছে

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আবারও এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকায় উঠেছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওযার বিষয়ে প্রথম আলোকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। অনুলিখন করেছেন শাকিলা হক

সেলিম রায়হান
সেলিম রায়হান

আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের সমস্যা তো শুধু কোভিডের সময় থেকে নয়, আগে থেকেই পুঞ্জীভূত সমস্যা। কোভিডের সময় অবশ্যই আলাদা একটি সময়। সে সময় বিভিন্ন ব্যাংকঋণ পরিশোধে নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এখন সেটা নেই। আবার নিয়মকানুন আরোপ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁরাও এই ছাড় আরও কিছুদিন চালানোর কথা বলছেন। এটা যদি আরও কিছুদিন চালানো হতো, তাহলে হয়তো খেলাপি ঋণ এতটা বাড়ত না।

সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণের যে সমস্যা, সেটা আমাদের ব্যাংকিং খাতে একটা বড় ধরনের সমস্যা, যা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। কিন্তু এটাকে সমাধান করার জন্য তেমন কোনো বড় ধরনের পদক্ষেপও আমরা দেখতে পাইনি। যেমন দীর্ঘদিনের দাবি ব্যাংকিং খাতের সংস্কার। খেলাপি ঋণ যাঁরা করছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, অথবা যাঁরা অনিচ্ছাকৃতভাবে করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের যাতে করতে না হয়, সে ব্যাপারেও কী ধরনের ব্যবস্থা হতে পারত। সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসনের জায়গায় বড় ধরনের ঘাটতি আছে।

আসলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের সমস্যার চটজলদি কোনো সমাধান নেই। আমরা দেখেছি, অনেক সময় অনেক সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়েছে, তাতে পরিমাণটা কমে গেল, আবার সংজ্ঞার কোনো অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হলো এবং পরিমাণ বেড়ে গেল। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিডের একটা প্রভাব আমরা দেখছি। সুতরাং এ জায়গায় আমার মনে হয়, ভর্তুকি সুদে ঋণ যারা নিচ্ছে, তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আরও কিছুদিন চালিয়ে নেওয়া যায় কি না, সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। কারণ সংকট চলমান। আমরা সানেমের পক্ষ থেকে গত বছরের জুন থেকে প্রতি ৩ মাস অন্তর ৫০০টি ফার্মের ওপর জরিপ চালাচ্ছি। অক্টোবরে যে জরিপ করেছি, সেখানে আমরা দেখেছি যে আসলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো পুনরুত্থান প্রক্রিয়ায় অনেক পিছিয়ে আছে। এটাও ঠিক, তারা ঋণও কম পেয়েছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায়। এদের একটা বড় অংশ এখনো পুনরুদ্ধারপ্রক্রিয়ায় ঝুঁকছে। তাই এটি চলমান রাখা যেতে পারে। অবশ্য কত দিন চালিয়ে নেওয়া যাবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।

খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের মূলে হাত দিতে হবে। আর সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ আমরা দেখছি না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব শক্তিশালী একটি ভূমিকা আছে। ব্যাংকিং খাতের নিয়মনীতিগুলো করার ক্ষেত্রে তাদের একটা স্বাধীন ভূমিকা থাকে। এমনকি ব্যাংকিং খাতের কোনো সংস্কার করতে চাইলে সেখানে তারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে অনেক কিছু করে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু সে ভূমিকা পালন করতে এখন পর্যন্ত পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে স্বাধীন ভূমিকা নেই, তা তারা নিজেরাও অস্বীকার করে না। ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত ভূমিকা আছে। একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আমরা দেখেছি, ব্যাংকিং খাতে অনেক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নেয় না। দেখা যায়, ব্যাংকিং ডিভিশন বা সরকারের অন্য পর্যায় থেকে নেওয়া হয়। অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক পরে সেটাকে ফলো করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা ও সর্বময় ক্ষমতা, সেটা কিন্তু তার এ মুহূর্তে নেই।

এ জায়গায় আমার মনে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে স্বাধীন ও নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা, সেটা এখনো সীমিত। তাদের নজরদারি করা ও পদক্ষেপ নেওয়ার ভূমিকা স্বাধীন থাকতে হবে। যখন তারা পদক্ষেপ নেবে কারও বিরুদ্ধে, সেটা যেন কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্য শক্তি দিয়ে ওভাররুল করা না যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে হবে।

দুটি উপায় আছে এ মুহূর্তে সমস্যা সমাধানের জন্য বা যারা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় আছে, তাদের কিছুটা ছাড় দেওয়ার জন্য। এক. কিছুদিনের জন্য বা কিছু সময়ের জন্য হলেও প্রণোদনা ঋণসুবিধা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আর এত পরিমাণ খেলাপি ঋণ এই অল্প কয়েকটি পদক্ষেপ দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই দুই নম্বর সমাধান হলো সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কারের দিকে যেতে হবে।

খেলাপি ঋণ কীভাবে হয়, সেটা বন্ধ করতে হবে। ঋণখেলাপি যাঁরা করেছেন, তাঁরা অনেকেই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রেই নানা মামলা আছে, যেগুলো সেভাবে আগায় না। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। অনেক মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলে। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বর্তমানে আমরা যা দেখি, তার থেকে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি।

আইএমএফের এক হিসাবেও তা বলা হয়েছে। তাই ওই হিসাবগুলো ধরলে আসলেই আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে বড় ধরনের একটা আশঙ্কার জায়গা আছে। এতে আমরা বড় বড় যে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা করছি, তা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।