>নতুন সরকার গঠিত হয়েছে গত মাসে। দেশের অর্থনীতি নিয়ে এই সরকারের সামনে কী চ্যালেঞ্জ আসছে? সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে কীভাবে এগোতে হবে সেই বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
প্রথম আলো: নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে দেশের অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেসব বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
আহসান এইচ মনসুর: সরকার পাঁচ বছরের জন্য গঠিত হলেও তাদের কিন্তু দীর্ঘকালীন একটি রূপকল্প (ভিশন) আছে। সেটি কমপক্ষে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। সেই ভিশন প্রশ্নাতীতভাবে উচ্চাভিলাষী, তবে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। উন্নত দেশ কে না হতে চায়! আমরা সবাই চাই, বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে, অবকাঠামোর উন্নতি হবে। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০৪১ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের শর্তপূরণ ও দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এ দুটোই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। সরকারের এসব লক্ষ্য অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। তবে লক্ষ্য অর্জন হোক বা না হোক, সরকারকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সেই চেষ্টা কোথায় কীভাবে করতে হবে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখি, চীন উন্নত দেশ হওয়ার পথে আছে। এখনো তাদের মাথাপিছু আয় ১০ থেকে ১১ হাজার ডলার। চীনের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, উন্নত দেশ হতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রতিবছরে গড়ে ৯ দশমিক ৬ থেকে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ১৮ হাজার ডলারে নিতে হবে। কারণ, মাথাপিছু আয়ের সংজ্ঞা পরিবর্তন হতে থাকবে।
প্রথম আলো: সরকারকে এসব লক্ষ্য অর্জনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে?
আহসান এইচ মনসুর: দেশের কর-জিডিপির হার এখন যেখানে আছে, এভাবে থাকলে লক্ষ্য অর্জন হবে না। তাই সরকারকে সবার আগে কর আদায়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এই খাতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা রয়েছে। কারণ, গত ১০ বছরে কর-জিডিপির হার ১ শতাংশও বাড়েনি। কিন্তু কর-জিডিপির হার ৯ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে আমাদের কমপক্ষে ২৫ শতাংশে নিতে হবে। কর আদায় কম হলে আমাদের পক্ষে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না।
কর আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের সামনে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে আর্থিক খাত। চীনের মতো দেশও আর্থিক খাত নিয়ে বর্তমানে সমস্যার মধ্যে পড়েছে। যদিও সম্পদের দিক দিয়ে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যাংক রয়েছে। তারা সমস্যা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, তবে এখনো অনেক দূরে। চীনের জাতীয় সঞ্চয়ের হার ৪৫ শতাংশ আর আমাদের ২৫ শতাংশ। এ জন্য আমাদের আর্থিক খাতে দক্ষতা বাড়াতে হবে।
সরকারের সামনে তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বিনিয়োগ বাড়ানো। এ জন্য খুব দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ১০ টাকার পণ্য যাতে ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে না হয়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। অবকাঠামোতে যে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে, তাতে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভালো সেবা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার মান উন্নত করাটাও খুব জরুরি। পাশাপাশি দেশের শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে নাগরিকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে ও ভালো সেবা দেয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সব মিলিয়ে দেশটিকে এমন এক উচ্চতায় নিতে হবে, যাতে এ দেশের যেসব তরুণ বিদেশে রয়েছে তারা দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া সরকারের সামনে চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। কর্মসংস্থান বাড়াতে না পারলে এ দেশের বিপুল জনশক্তি একপর্যায়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কর্মক্ষম জনশক্তিকে যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা তৈরি হবে। গত পাঁচ বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার ছিল খুবই কম। তাই বেকারের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারই বেশি। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থানহীনতা একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা।
প্রথম আলো: দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ দরকার?
আহসান এইচ মনসুর: উন্নত দেশ হতে হলে শিল্পায়ন করতে হবে। সে জন্য অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে বিনিয়োগ আসবে না। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা এক জায়গায় সব সেবা পাওয়ার সুবিধা চালু করতে হবে। ভূমির মালিকানা নিয়ে যে সমস্যা আছে, তা দূর করতে হবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো যাতে দ্রুত সফলতার দেখা পায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথ প্রশস্ত হবে।
প্রথম আলো: দেশের আর্থিক খাত নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এ খাতের উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: আর্থিক খাতে দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিমা খাত ও শেয়ারবাজারকে আরও অনেক বেশি উন্নত করতে হবে। বন্ড মার্কেট উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে আর্থিক খাতের সমস্যা ও সমাধানের পথ চিহ্নিত। এখন বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। আর্থিক খাতের অনিয়মের জন্য যারা দোষী, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের একটা বড় ধরনের চাপ দিতে হবে। আমাদের এমন একটা পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে কম সুদে ঋণ দেওয়া যায়। এ জন্য আমানত ও ঋণের সুদ হারের ব্যবধান কমাতে হবে। আমি মনে করি, ব্যাংক খাতের কিছু অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনা গেলে ঋণের সুদ হার কমানো সম্ভব। ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ালে খরচ বাড়বে। নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে কখনোই সুদ হার কমানো যাবে না। তাই সময় এসেছে কিছু কিছু ব্যাংক অধিগ্রহণ ও একীভূত করার। কিন্তু আমরা তা না করে খারাপ ব্যাংকগুলোকে নামবদল করেও টিকে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছি। তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। সমস্যা সমাধান করতে হলে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
প্রথম আলো: দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। আপনি কী মনে করেন এটি উদ্বেগজনক অবস্থায় চলে গেছে? বৈষম্য কমাতে সরকারের কী ধরনের উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: সমাজের ধনী-গরিব বৈষম্য কমাতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চাকরির সুযোগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সেবা ও সুযোগ সমাজের সবার জন্য সমান হারে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। ঋণখেলাপিরা শাস্তির বদলে নতুন করে ঋণ পাচ্ছেন। অনেক বড় ব্যবসায়ী কর দিচ্ছেন না। এভাবে চলতে পারে না। তাই বৈষম্য কমাতে সরকার একটি রূপকল্প তৈরি করলে সবচেয়ে ভালো হয়। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করার মাধ্যমে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তা ছাড়া যাঁদের সম্পদ আছে, তাঁরা যেন যথাযথ কর দেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজের কাউকে বঞ্চিত করে তো উন্নত দেশ হওয়া যাবে না।