সত্যি সত্যিই সপ্তদশ শতাব্দীতে গৌরী সেন নামে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। যেসব গরিব মানুষ কোষাগারে কর দিতে পারত না, গৌরী সেন তাদের হয়ে কর দিয়ে দিতেন। সেই থেকে বলা হয়, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। এ রকম এক গৌরী সেনের সন্ধানে সরকার এখন নিজেই।
কেননা কর আদায় কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে এখন একধরনের মন্দাভাব যাচ্ছে। উৎপাদন খাত শ্লথ হয়ে পড়ায় সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর—সব ক্ষেত্রেই আদায় কম। আয় কমে যাওয়ায় এখন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সরকারের হাতে আছে একগুচ্ছ বৃহৎ প্রকল্প, আছে দৈনন্দিন খরচ। বছরের পর বছর ধরে চলা এসব প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়াচ্ছে সরকার। সব মিলিয়ে ব্যয় বেড়েই চলছে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে আশা-ভরসার জায়গা এখন একটাই—ব্যাংক খাত। আর এই ব্যাংকই এখন সরকারের জন্য একমাত্র গৌরী সেন। সরকারের কাজই এখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা।
কিন্তু দেশের ব্যাংক খাত আছে ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। একদিকে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ নিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাত পাচ্ছে সবচেয়ে কম ঋণ। খেলাপি ঋণও নিয়ন্ত্রণে নেই। এখন আবার সরকারি নির্দেশে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সবশেষ সংকট হচ্ছে, এবার সত্যি সত্যিই ঋণ ও আমানতের সুদহার ৯ ও ৬ শতাংশে নির্ধারণে বাধ্য হচ্ছে তারা। সব মিলিয়ে সুশাসনের সংকটে থাকা দেশের ব্যাংক খাত এখন নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত। এই অবস্থায় সরকারের গৌরী সেন হওয়া ছাড়া ব্যাংক খাত আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।
এক দশকে সর্বোচ্চ ধার
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের একটি করে মাস পার হচ্ছে, আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরকারের ব্যাংকঋণ। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছিল। অথচ অর্থবছর শুরু অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে গত ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়ে ফেলেছে ৪৯ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। অথচ দুই মাস আগেও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ মাসে ঋণ নেওয়া হয়েছিল যেখানে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সরকারের ঋণ নেওয়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে তা এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩০ জুনেও ব্যাংক ব্যবস্থার কাছে সরকারের মোট ঋণ ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এখন ১ লাখ ৫৭ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরকারের ঋণ এখন ৪০ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে। এবার সরকারকে এত ঋণ নিতে হচ্ছে কেন—এ ব্যাখ্যা জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত রোববার অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে তাঁর কার্যালয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অর্থসচিবের একান্ত সচিব মো. হেলালউদ্দিন জানান, সচিব এ ব্যাপারে কথা বলবেন না বলে তাঁকে বলতে বলেছেন।
মোটাদাগে দুই কারণ
চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা বাজেটের ঘাটতি (অনুদান বাদে)। এ ঘাটতি পূরণেই সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে।
>সরকারের আয় কমে গেছে, ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে।
মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একার দায়িত্বই হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আদায় করা। এর মধ্যে প্রথম ছয় মাস বা জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। অথচ এনবিআরকে গতবারের নিট আদায়ের চেয়ে এবার ৪৫ শতাংশের বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও অনেক কমে গেছে। উচ্চ হারে সুদ দিয়ে হলেও এই উৎস থেকে প্রতিবছর সরকার যে ভালো এটা অঙ্ক সংগ্রহ করত, এবার আর তা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী জুলাই-নভেম্বর সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রি ছিল ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার গত নভেম্বরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১৮ সালের নভেম্বরে যা ছিল ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
কেন এত ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির সর্বশেষ চিত্র রয়েছে জুলাই-আগস্ট দুই মাসের। এই দুই মাসে শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা কমেছে ১৯ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
আবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আগেরবার একই সময়ে যা বেড়েছিল ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পুরো অর্থবছরে যদি শেষ পর্যন্ত রপ্তানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি থাকে, তাহলে এটিও হবে এক দশকের মধ্যে প্রথম ঘটনা।
এত সব নেতিবাচক চিত্রের সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়ার বড় যোগসূত্র রয়েছে। আবার কেবল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যই যে বেহাল; তা নয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চিত্রও সুখকর নয়।
গত এক দশকে দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী সরকার নিজেই। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট জিডিপির অনুপাতে সরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর এখন সেই বিনিয়োগের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ থেকে অল্প বেড়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেসরকারি বিনিয়োগ। গত ১০ বছরে এই বেসরকারি বিনিয়োগ খুব বেশি বৃদ্ধি না পাওয়ায় কর্মসংস্থানও খুব বাড়েনি। গত দশকের অগ্রগতিকে অনেক বিশ্লেষকই কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলছেন। কর্মসংস্থান বাড়েনি বলে আয়ও সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। আর মজুরি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে প্রকৃত আয় বৃদ্ধির হারও অতি সামান্য।
অর্থনীতিতে এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, চাহিদা কি কমে যাচ্ছে, মানুষের হাতে কি টাকা নেই, চাহিদা কমে গেছে বলেই কি শিল্পে উৎপাদনও কমে যাচ্ছে—এসবেরই প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সরকারের ব্যয় বিনিয়োগ সমস্যা কাটবে না বলেই অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।
অর্থনীতির অনিশ্চিত যাত্রা
ব্যাংক খাত থেকে সরকার যখন বেশি ঋণ নেয়, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বা শিল্পকারখানা গড়তে ব্যাংকগুলো তখন বেসরকারি খাতে তেমন ঋণ দিতে পারে না। এটা জেনেও নগদ টাকার সংকট মেটাতে সরকার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভর করছে ব্যাংক খাতের ওপর।
তবে ব্যাংকে অর্থ থাকলেই যে বেসরকারি খাত ঋণ নেবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ জন্য বিনিয়োগের পরিবেশ থাকাটা জরুরি। সরকার এখন মনে করছে, সুদের হার ৯ শতাংশ করলেই বিনিয়োগ বাড়বে। তবে ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় নয়, সরকারের নির্দেশে সুদহার কমাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া কেবল সুদহার কমালেই বিনিয়োগ হবে, এমন কোনো উদাহরণও কোথাও তৈরি হয়নি; বরং সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের এই বেশি মাত্রার ঋণ গোটা ব্যাংক খাতকেই সংকটে ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
সামগ্রিক বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা আছে। এ ছাড়া অর্থনীতিকে অন্য সব সূচকও নেতিবাচক। শুধু প্রবাসী আয়ে বেশ প্রবৃদ্ধি আছে। দেশের অর্থনীতি খারাপ থাকায় হয়তো প্রবাসীরা দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের জন্য বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
এ বছর কৃষি, উৎপাদন খাতসহ বিভিন্ন খাত ভালো করছে না। নতুন বিনিয়োগও আসছে না। ফলে পুরো বছরে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা নয়। আর তাহলে পরিবহন খাতসহ সেবা খাতের অন্য খাতগুলো চাঙা হবে না। অন্যদিকে বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান খুব বেশি বাড়বে না। ফলে সেবা নেওয়ার মতো আয় মানুষের তৈরি হবে না। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায়, অর্থনীতিতে একধরনের মন্দাভাব যাচ্ছে।