এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা পালন করতে পারছে না

মাহমুদ ওসমান ইমাম।
মাহমুদ ওসমান ইমাম।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আরও তিনটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ব্যাংক খাতের নানা সমস্যা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের পরিচালক মাহমুদ ওসমান ইমাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম


প্রথম আলো: দেশের ব্যাংক খাত কেমন আছে?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: ভালোই সংকটের সময় পার করছে। যেভাবে চলছে তা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে। বড় আকারের খেলাপি ঋণ তো আছেই। হস্তক্ষেপ করে এবং বাস্তবতার বাইরে গিয়ে যেভাবে সুদের হারকে নয় ও ছয় শতাংশ করা হলো; সত্যিই তা নয়-ছয় হয়েছে। ব্যাংক খাত কি আদৌ এর জন্য প্রস্তুত? যদি না হয়, খাতটিকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। ওদিকে আছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। অবলোপন আছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। পুনঃ তফসিলের পরিমাণটা অবশ্য বলা নেই। তবে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বাড়ে, আর ডিসেম্বরে তা কমে। পুনঃ তফসিল হলো অ্যাডহক, দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান নয়। এককালীন জমা দিয়ে দুবার, তিনবার পুনঃ তফসিল করা যায়, কিন্তু এখন চতুর্থবারও করতে দেখি।

প্রথম আলো: চতুর্থ বা তারও বেশিবারের জন্যও পুনঃ তফসিল করতে দেখা যাওয়ার কারণ কী? বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ব্যাপারে ভূমিকা কী?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: আসলে যেসব গ্রাহক পুনঃ তফসিল করতে আসেন, তাঁরাই এখানে আসল। এক দল আছেন আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। আবার কেউ বলেন পুনঃ তফসিল না করলে আমি দিতে পারছি না। ব্যাংকের করণীয় কী তখন? পুনঃ তফসিল না করলে খেলাপি করতে হয় বা অবলোপন করতে হয়। তখন আবার ব্যাংককে এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন রাখতে গেলে আবার ঋণ দেওয়া বা মুনাফা অর্জনের সক্ষমতা কমে যায়। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদেরও ভালো মুনাফা দেওয়া যায় না।

প্রথম আলো: গত ১০ বছরে ১১টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার পর সম্প্রতি নতুন আরও ৩টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কীভাবে দেখছেন?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: জাতীয় সঞ্চয়ে কিন্তু আমানতের প্রবৃদ্ধি আছে। নতুন ব্যাংক আসার পর আমানত সংগ্রহের একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা গেছে ব্যাংকগুলোর মধ্যে। নতুন তিনটি ব্যাংক আসার পর এই প্রতিযোগিতা তীব্রতর হবে। ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ ও আমানতের সুদের হারের পার্থক্য নিয়ে এমনিতেই জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমানতের সুদ হার মূল্যস্ফীতির কাছাকাছি বা নিচে নেমে গেলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। সে ব্যাংকই বেশি সুদ দেবে, যে ব্যাংক বেশি ভালো নয়। তখন ভালো ব্যাংকগুলোকেও তীব্রতর সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। মোটা দাগে অস্থিরতা শুরু হবে গোটা খাতে।

প্রথম আলো: বিদ্যমান রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সমস্যার ধরন কি একই রকম, না আলাদা?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: খেলাপি ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে বললে সমস্যার ধরন সমজাতীয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ প্ররোচনায় ঋণ দেওয়া হয়েছে। যেমন সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, আর বেসিক ব্যাংক তো পুরোটাই। বেসিক ব্যাংকের প্রসঙ্গে পরে আসছি। এতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপকে নিয়ে নতুন করে আলোচনায় জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি খারাপ হয়ে গেছে। তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কারণে খেলাপি ঋণ বেশি।

প্রথম আলো: অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সেদিন বললেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় খেলাপি ঋণের হার সহনীয় মাত্রাতেই রয়েছে। চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।

মাহমুদ ওসমান ইমাম: আমি কিছুটা দ্বিমত পোষণ করি। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের যে চিত্র আমরা দেখছি, বাস্তবে তা দ্বিগুণের কাছাকাছি। আমার মনে হয়, ব্যাংকগুলো ঠিকই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাচ্ছে। কিন্তু এগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি কম। কম হওয়ার কারণ হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্রথম আলো: আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তো চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেয় এবং প্রয়োজনে বরখাস্ত করে। ব্যাংক খাতের একমাত্র নিয়ন্ত্রক তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখানে দায় এড়ানোর কৌশল নিচ্ছে না তো?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: এই যে নিয়োগ দেয়, এখানেই তো সমস্যা। ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ‘ফিট অ্যান্ড প্রপার টেস্ট’ নীতি রয়েছে, সে অনুযায়ী এ নিয়োগটা হচ্ছে না। একসময় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো কোম্পানি ছিল না। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সুশাসন বজায় রাখার কথা বলে সেগুলোকে কোম্পানি করা হলো। উদ্দেশ্য কিন্তু সফল হলো না। কেন হলো না? আমি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছি, পর্ষদ সদস্যদের নিয়োগ-বরখাস্তের ক্ষমতাটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হাতে থাকা। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যাওয়া উচিত।

প্রথম আলো: নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় এখন অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন এনেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আগে সরাসরি নিয়োগ দিলেও এখন নাম ঠিক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে নিয়োগ দিতে পর্ষদকে চিঠি পাঠায়। তবে এ দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: পর্ষদ সদস্যরা তখন অন্তত একটা চাপ অনুভব করতেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো কারণেই হোক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কোনো সিদ্ধান্ত বা পরামর্শকে এড়াতে পারে না। কারণ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার খর্ব হয়ে গেছে। আবার বেসরকারি ব্যাংকের কথায় যদি আসি, মালিকানার সিদ্ধান্ত হোটেলে বসে ঠিক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তা অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। যে অনুমোদন দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় কার্যালয়ে ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অক্ষমতা বিষয়ে এর চেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে না। নিশ্চয়ই এমন কোনো বিষয় ছিল, যার কারণে গভর্নরকে থাকতে হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেই যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অক্ষমতা থাকে, সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে কী, তা সহজেই অনুমেয়। এ কারণেই বলতে চাইছি, বাংলাদেশ ব্যাংক তার ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

প্রথম আলো: বেসিক ব্যাংক নিয়ে কী যেন বলতে চেয়েছিলেন?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: এর কাহিনিটা একেবারেই আলাদা। কতবার যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়েছে, কিন্তু কেলেঙ্কারির জন্য মূল ব্যক্তি ও জড়িত অন্যদের শাস্তি দেওয়া হলো না। যিনি বহুলভাবে পরিচিত, তাঁকে কিন্তু তদন্তের বাইরে রাখা হয়েছে। দুদক নোটিশ করেছে, শুনানিও নিয়েছে। দেখা যাক, দুদক এখন কী করে। এই বিষয়গুলো যখন স্পষ্ট হয়ে যায়, তখন সবাই মনে করেন এসব ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে যাওয়াটাই অসুবিধা।

প্রথম আলো: ব্যাংক খাতের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা অনেকে বলছেন। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। কী কারণ হতে পারে?

মাহমুদ ওসমান ইমাম: অস্থায়ী, কিন্তু স্বাধীন একটা ব্যাংক কমিশন হওয়া জরুরি। নইলে তিন বছর পর সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বলা মুশকিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকবল বেড়েছে কিন্তু কাজ করতে পারছে না, সমস্যাটা আসলে কোথায়? আবার যদি বলি সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) কমাতে বলেছে মন্ত্রণালয়, অথচ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এগুলোই তো হস্তক্ষেপ। ব্যাংক কমিশন সুপারিশ করতে পারত। সুপারিশগুলোর কিছুও যদি মানা হতো, তাহলে পুরো ব্যাংক খাত, অর্থনীতি তথা সরকারেরই উপকারে আসত।