বেসিক ব্যাংক নিয়ে কিছু বলা নীতিনির্ধারকদের জন্য মোটামুটি একটা নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদে, সংসদীয় কমিটিতে, সভা–সমিতি কিংবা সেমিনারে ব্যাংক নিয়ে আলোচনা মানেই বেসিক ব্যাংক।
৯ বছর ধরে এভাবে বেসিক ব্যাংক নিয়ে কথাবার্তা কম হলো না। কিন্তু বেসিক ব্যাংক সেই আগের জায়গাতেই পড়ে আছে। কারণ, সবাই অনেক কথাই বলেন, কিন্তু আসল জায়গায় কেউ হাত দেন না।
নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার নিজেই বেসিক ব্যাংকে গিয়েছিলেন। আর এর মাধ্যমে বেসিক ব্যাংক নিয়ে কথা বলার নতুন অধ্যায় তিনিও শুরু করলেন। এর আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকটি নিয়ে অনেক কড়া কড়া কথা বলতেন। সেসব কথাবার্তায় শুরুতে ছিল হুঁশিয়ারি, শেষের দিকে অসহায়ত্ব। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
নতুন অর্থমন্ত্রী বেসিক ব্যাংকে গিয়ে আশার কথা বললেন, হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন, ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন এবং সবশেষে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ক্রেস্ট নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। খুব ভালো কথা। তাহলে এবার কিছু একটা হবে—এ রকম একটা অনুভূতি আনার চেষ্টা কেউ কেউ করতে পারেন। তবে পুরো বক্তৃতা পড়ার পরে মনে হলো, বেসিক ব্যাংক নিয়ে নিয়মিত বক্তৃতামালার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু। এ ধরনের কথাবার্তা সামনে আরও হয়তো শুনতে হবে। খুব বেশি হলে আবার কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা হয়তো শাস্তি পাবেন, প্রভাব নেই এমন কিছু ব্যবসায়ীকেও হয়তো জেলে যেতে হবে। কিন্ত আসল ব্যক্তিটি থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নতুন অর্থমন্ত্রী, তাই শুরুতে বেসিক ব্যাংকের আসল হোতার নামটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক। তাতে তাঁর কাজের সুবিধা হতে পারে। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত জাতীয় সংসদে বেসিক ব্যাংক নিয়ে যা বলেছিলেন, সেটা উল্লেখ করলেই যথেষ্ট। অর্থমন্ত্রী সে সময় লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক কর্তৃক নিয়োগকৃত বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের দাখিলকৃত কার্যভিত্তিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।’ বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ২৭ জন কর্মকর্তা, ৫৬টি ব্যবসায়িক ও ৮টি সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল উল্লেখ করে সাবেক অর্থমন্ত্রী তাদের তালিকাও উপস্থাপন করেছিলেন।
আমরা জানি, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছিল। তবে এর আগে আবদুল হাই বাচ্চুকে পদত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয়। এত কিছুর পরও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন পর্যন্ত শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি।
কেন পায়নি? এর উত্তরও সাবেক অর্থমন্ত্রী ২০১৬ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে দিয়েছিলেন। ওই দিন সংসদে তিনি হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে নতুন অর্থমন্ত্রী বেশ ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলেছেন, ব্যাংকটির মাত্র ৭২টি শাখার জন্য ২ হাজার ১০০ কর্মকর্তা–কর্মচারী রয়েছেন। যে ব্যাংকে এত জনবল, তারা বছরে ৩৫৪ কোটি টাকা লোকসান দেয় কীভাবে? ব্যাংকের এত জনবল কী কাজ করে? এরপর অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের উদ্দেশে বলেন, ব্যাংকের লোকসান কমাতে কর্মকর্তারা বসে সিদ্ধান্ত নেন, কী করবেন। আমাকে আপনাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। পরবর্তীকালে আমিও আমার সিদ্ধান্ত নেব। একপর্যায়ে অর্থমন্ত্রী পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেন। যদিও তেমনটি চান না, তা–ও বলেছেন। বেতন-ভাতা কম নিতেও বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
বেশ কড়া কড়া কথা সন্দেহ নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর দুটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যেমন তিনি বলেছেন, অর্থের অভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় না, বন্ধ হয় ম্যানেজমেন্টের কারণে। আরও বলেছেন, ‘ব্যাংকটি বন্ধ করতে চাই না। আশা করব, বেসিক ব্যাংক অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে।’
আমরা জানি, বেসিক ব্যাংক নষ্ট হয়েছে ব্যাংকটির ম্যানেজমেন্টেরই কারণে। খুব পরিষ্কারভাবে বললে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মূল ব্যক্তিটির কারণে। আর রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পর্ষদ চেয়ারম্যানকে সব ধরনের সহায়তা করেছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের কেউ কেউ। সুতরাং এদিকেই আগে হাত দিতে হবে। আর অর্থমন্ত্রী যে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বললেন, সেই ঐতিহ্য ধ্বংস হয়েছিল সরকারেরই একটি সিদ্ধান্তের কারণে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে একটি ব্যাংক ভালো চলতে পারে, তার বড় উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক। এর পর্ষদের প্রধান হতেন একজন সচিব, আর পরিচালক হতেন সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যয়ের মানুষ। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে কখনো এই ব্যাংকে ঢোকানো হয়নি। এই ঐতিহ্য ভাঙা হয় ২০০৯ সালে, চেয়ারম্যান হন জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা শেখ আবদুল হাই। এরপরেই ধ্বংসের মুখে চলে যায় বেসিক ব্যাংক। সুতরাং অর্থমন্ত্রী যদি আসলেই ব্যাংকটির হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে চান, তাহলে বেসিক ব্যাংকের বেসিক জায়গায় হাত দিতে হবে। আবদুল হাই বাচ্চুসহ প্রকৃত দায়ীদের শাস্তি দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই নিচে যাঁরা আছেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের বজায় থাকবে।