বিশ্লেষণ

ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনা ব্যাংক খাতের জন্যই দুঃসংবাদ

ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে গত শুক্রবার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দাওয়াতে গিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পত্রিকায় দেখলাম, অর্থমন্ত্রীকে বিএবির নেতারা জানিয়েছেন, বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকে দুর্ঘটনা হয়েছে এবং ব্যাংকটিকে সুস্থ করতে কেউ এগিয়ে আসছে না।

‘দুর্ঘটনা’ হয় হঠাৎ। সুতরাং এই শব্দটি ব্যবহার করে অত নমনীয়ভাবে দেখার সুযোগ কম। ফারমার্স ব্যাংকে হঠাৎ করে কিছু হয়নি। ফারমার্স ব্যাংকে যা হয়েছে তা-ই বলতে হবে। ব্যাংকটিতে হয়েছে আসলে অনিয়ম। দুর্নীতিও হয়েছে। ফলে ব্যাংকটা এখন গভীর সংকটের মুখে। আমানতকারীরা ব্যাংকে গিয়ে নিজেদের টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না-ফারমার্স ব্যাংকের এ ঘটনা গোটা ব্যাংক খাতের জন্যই দুঃসংবাদ।

সরকার কোনো ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দিতে চায় না বলেই ফারমার্স ব্যাংকের জন্য বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) সরকার বলে দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংককে ৭১৫ কোটি টাকা দিতে। সেটা কোনো সমস্যা নয়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কাছে উদ্বৃত্ত টাকাও আছে। সমস্যা অন্য জায়গায়। সরকার যে আস্থার সংকট সৃষ্টিকে ভয় পাচ্ছে, সেটারই সুযোগ নিতে চাইছে বিএবি।

বিএবি ভালো করেই জানে যে ফারমার্স ব্যাংককে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে সরকারই দেবে না। বিএবি এ-ও জানে, পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে এ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও পিছুটান রয়েছে। ফারমার্স ব্যাংককে সামনে রেখে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য তাই একগাদা সুবিধা দাবি করে বসল বিএবি।

বিএবির লোকেরা এর আগেও সরকারকে চাপ দিয়ে শুধু নিজেদের স্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করিয়ে ছেড়েছেন। আইন সংশোধনের ফলে এখন এক ব্যাংকে চারজন পরিচালক থাকতে পারেন এক পরিবার থেকেই, তা-ও আবার টানা ৯ বছর। আগেও বলেছি, আবার বলছি, এটা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন ৪০-৫০টা পরিবারের হাতে ব্যাংক খাত কুক্ষিগত। পরিবারগুলোকে আমার কাছে পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার গত শুক্রবার অর্থমন্ত্রীর কাছে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো গলাবাজির নামান্তর। অর্থনীতিতে বেসরকারি ব্যাংকের ৭০ শতাংশ অবদানের পরিসংখ্যান তিনি কোথায় পেলেন? তিনি বড়জোর এটা বলতে পারেন যে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের ৭০ শতাংশ সংগ্রহ করছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের আমানতের ৭৫ শতাংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে এবং ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখতে পারে। পত্রিকায় দেখলাম, বিএবির আবদারের মুখে অর্থমন্ত্রী একই দিন জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত রাখার হার হবে ৫০: ৫০, অর্থাৎ অর্ধেক-অর্ধেক। কোনো বিচার-বিশ্লেষণ, সমীক্ষা বা সম্ভাব্য প্রভাব যাচাইয়ের আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যাংক খাতের জন্য বুমেরাং হতে পারে।

ব্যাংকে তারল্যসংকট মোকাবিলা করতে এরই মধ্যে আমানতের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে বেড়ে গেছে ঋণের সুদও। এই দুই সুদহারের পার্থক্য থাকা উচিত সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হার।

আমানতকারীদের টাকার পাশাপাশি সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের টাকাও যে ফারমার্স ব্যাংক ফেরত দিতে পারছে না, এই আস্থার সমস্যা আরও বেসরকারি ব্যাংকে যেন ছড়িয়ে না পড়ে। ভয়ের কারণ হচ্ছে, ঋণ কেলেঙ্কারি ক্রমেই বাড়ছে, কেলেঙ্কারি থামানো দরকার। কে থামাবে? ভরসা রাখতে চাই ঘুরেফিরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক বেশি শক্ত হতে হবে। সরকারকেও ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনকে সম্মান করতে হবে।