করোনাকাল

পুনরুদ্ধারের পথে অর্থনীতি

  • সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ভালো হচ্ছে। ফলে করোনাভীতি কাটিয়ে অর্থনীতিও সচল। তবে এখনো মূল চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

  • কোভিড-১৯–এর সম্ভাব্য দ্বিতীয় ধাক্কা পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রকট হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়বে।

  • চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪৬ শতাংশ। রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয়, রপ্তানির অল্প প্রবৃদ্ধি, কম আমদানি ব্যয় এবং বাড়তি বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বেড়ে চলছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক ভালো হচ্ছে। অবিশ্বাস্য অর্জন প্রবাসী আয়ে। রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে পোশাক খাত। খুলেছে কলকারখানা। উৎপাদনে গতি বেড়েছে। আর কৃষি খাত তো বন্ধ হয়নি কখনোই।

সব মিলিয়ে কোভিড-১৯–এ বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পুনরুদ্ধারের গতি কতটা দ্রুততর হবে। বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর পুনরুদ্ধারের গতি এখনো শ্লথ। চীন ছাড়া সবারই প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা মনে করছে, বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার খুব দ্রুততর হবে না।

দেশে উৎপাদন কর্মকাণ্ড সচল হলেও চাহিদা আগের পর্যায়ে যায়নি। মানুষও ফেরেনি আগের আয়ে। চাকরি হারিয়েছে অনেকে। গ্রামে ফিরে গেছে বহুসংখ্যক মানুষ। অনানুষ্ঠানিক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্রও এখনো স্পষ্ট নয়। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা তহবিল বড়দের জন্য সহায়ক হলেও ছোটরা পাচ্ছে কম।

এ অবস্থায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার নিয়ে সব আশঙ্কা দূর হয়নি। কোভিড-১৯–এর সম্ভাব্য দ্বিতীয় ধাক্কা পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রকট হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে প্রবাসী আয়ও বড় ধাক্কা খাবে। আবার প্রণোদনার অর্থ উৎপাদন খাতে না গেলে ঘটবে মূল্যস্ফীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে নিম্ন কর্মসংস্থান ঘটলে সেটি হবে অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুনরুদ্ধারপ্রক্রিয়া টেকসই করতে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ হলো দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কারণ, করোনার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের আবার কাজে ফিরিয়ে আনতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, জুলাইয়ের পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহ বোঝার জন্য যেসব চলক আছে, সেগুলো ভালো করছে। যেমন, প্রবাসী আয় বেড়েছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার রেকর্ড ফলন হয়েছে। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে রপ্তানি গতবারের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে। এ ছাড়া অর্থনীতির শক্তিমত্তার প্রতিফলন ঘটায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। এটি এখন ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

তবে শামসুল আলম মনে করেন, অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ হলো দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কারণ, করোনার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের আবার কাজে ফিরিয়ে আনতে হবে।

আশা জাগাচ্ছে রপ্তানি

কোভিড-১৯–এর প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই একটি বাদে বাকি প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধি ছিল না, আমদানিতেও ছিল একই অবস্থা। রাজস্ব আয়ে ছিল বড় ঘাটতি। আয় কম থাকায় সরকারের ঋণ নেওয়া বাড়ছিল, বেসরকারি বিনিয়োগ তো বহু বছর ধরেই ছিল স্থবির। এর মধ্যেই মহামারির আঘাত।

জুন মাস থেকে ক্রমান্বয়ে অর্থনীতি খুলে দেওয়ার পর প্রথম সুসংবাদ দেয় রপ্তানি খাত। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আমদানির সূচক অবশ্য এখনো খুব আশাপ্রদ নয়। জুলাই-আগস্ট সময়ে এই খাতে এখনো প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশের মতো ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। অর্থনীতি আগের জায়গায় ফিরে না গেলে আমদানি খুব বেশি বাড়বে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রবাসী-আয় বৃদ্ধির পেছনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের একটি নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হয়, এতে অবৈধ পথে অর্থ পাঠানোর প্রবণতাও কমে গেছে।

অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধি প্রবাসী আয়ে

মহামারির কারণে প্রবাসী শ্রমিকেরা কাজ হারাবেন, বড় অংশের দেশে ফিরতে হবে, অনেকের আয় কমবে—এসব কারণে দেশে অর্থ পাঠানো কমবে বলেই মনে করা হয়েছিল। গত এপ্রিলেই বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছিল মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয় কমবে ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় পাওয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪৬ শতাংশ। রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয়, রপ্তানির অল্প প্রবৃদ্ধি, কম আমদানি ব্যয় এবং বাড়তি বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বেড়ে চলছে।

তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা মনে করছে, ভবিষ্যতে প্রবাসী আয়ের এই ধারা থাকবে না। বিশ্বের শীর্ষ তিন ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের একটি ফিচ রেটিং বলছে, অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমবে ১২ শতাংশ। কেননা, তেলের দাম কমার কারণে মধ্যপ্রাচ্য আগে থেকেই সংকটে ছিল। সৌদি আরব ব্যয় সাশ্রয়ের পথ নিয়েছে। এরই মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে দেশে ফিরেছেন। ফলে অনেকেই সর্বস্ব দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আপাতত বিভিন্ন দেশে প্রবাসী আয় বাড়ার এটাই বড় কারণ।

তবে বাংলাদেশে প্রবাসী-আয় বৃদ্ধির পেছনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের একটি নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হয়, এতে অবৈধ পথে অর্থ পাঠানোর প্রবণতাও কমে গেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে না গেলে এই আয় থাকবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ৬ শতাংশ।

আশঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ে

মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ৬ শতাংশ। তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি অল্প অল্প করে বেড়েছে। বাড়ছে চালের দাম। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকার সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থের প্রণোদনা তহবিল গঠন করা হয়েছে, যার বড় অংশই কম সুদের ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে একে বলেছে ‘অস্বাভাবিক সহজ অর্থ’। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, এর ফলে মূল্য স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

প্রণোদনার অর্থ উৎপাদন খাতে যদি না যায় এবং এই অর্থ যদি শেয়ারবাজার বা স্থায়ী সম্পদ কেনাকাটায় চলে যায়, তাহলেও বাড়বে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধার ও মূল্য স্থিতিশীলতার মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে সক্রিয় নজরদারি এবং নীতির সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।

প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর ঋণে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ। জুলাইয়েই বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

সঞ্চয় বনাম বিনিয়োগ

অনিশ্চয়তায় মানুষের সঞ্চয় বাড়ে, কমে খরচ। এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিক প্রবণতা। তবে খরচ কমিয়ে দিলে চাহিদা বাড়বে না। আর চাহিদা না থাকলে বিনিয়োগেও আগ্রহী হবেন না উদ্যোক্তারা। তাতে নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না। কর্মসংস্থান না বাড়লে মানুষের আয়ও বাড়বে না। এটা একধরনের চক্র।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর ঋণে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ। জুলাইয়েই বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। জুন মাসে যা ছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ ও মে মাসে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। মূলত কম সুদের প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে ঋণ বাড়তে শুরু করেছে।

পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া কতটা টেকসই

চীন ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির বড় দেশগুলোর কেউই প্রবৃদ্ধির কথা ভাবছে না। সব দেশই চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বড় শক্তি রপ্তানি। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলে অর্থনৈতিক মন্দা গভীর হতে পারে। স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় ঢেউ প্রথমটির চেয়ে বেশি জোরদার ছিল। ফলে ওই সব দেশের নাগরিকদের চাহিদা কমে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা রাখতে হলে প্রথমেই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নতুন স্বাভাবিক জীবন চালু করা সম্ভব হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা তৈরি হবে। এ ছাড়া পুরোনো গরিবদের পাশাপাশি নতুন গরিবদের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা করা উচিত।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন

এ পরিস্থিতিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগেই তৈরি পোশাকের যে অর্ডার এসেছে, তা দ্রুত সরবরাহ করা উচিত। এ জন্য লিড টাইম কমাতে সরকারকে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরে গতি আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ প্রথম আলোকে আরও বলেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা রাখতে হলে প্রথমেই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নতুন স্বাভাবিক জীবন চালু করা সম্ভব হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা তৈরি হবে। এ ছাড়া পুরোনো গরিবদের পাশাপাশি নতুন গরিবদের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা করা উচিত। এতে তাদের নগদ টাকা যাবে। অর্থনীতি চাঙা হবে। আর সবকিছু খুলে দেওয়ায় মানুষের মধ্যে একধরনের স্বস্তি এসেছে ঠিকই, কিন্তু করোনার আগে যে আয় তাঁরা করতেন, এখন আর সেই আয় করতে পারছেন না। ফলে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই ঘুরে দাঁড়ানো কতটা টেকসই হবে, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।