এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার

পদ্মা সেতু চালু হলে বিনিয়োগ বাড়বে

মোস্তাফিজ আহমেদ
মোস্তাফিজ আহমেদ
>

দেশে কয়ার ম্যাট্রেসের কাঁচামাল (কয়ার ফেল্ট) তৈরির প্রতিষ্ঠান ন্যাচারাল ফাইবারের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ। অপ্রচলিত কৃষিপণ্য থেকে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি তিনি দেশের রপ্তানি তালিকায় যোগ করেছেন নতুন নতুন পণ্য। বাজেট সামনে রেখে বাগেরহাটসহ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানার সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই উদ্যোক্তা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাগেরহাট প্রতিনিধি ইনজামামুল হক।

প্রথম আলো: সামনে বাজেট। বাজেট সামনে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

মোস্তাফিজ আহমেদ: প্রতিবারই বাজেটকে কেন্দ্র করে আমাদের অনেক প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা আর পূরণ হয় না। গতানুগতিকভাবে বাজেটে আগের বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখনো অনেকটাই অনুন্নত এলাকা। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম। একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে শিল্পকারখানার ওপর। দেশে শিল্পকারখানা যত বেশি হবে, কর্মসংস্থান তত বাড়বে। এটাই নিয়ম। কিন্তু এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। এ কারণে উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন না। তাই আগামী বাজেটে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তোলার জন্য বিশেষ প্রণোদনার সুযোগ রাখার দাবি জানাচ্ছি।

প্রথম আলো: ব্যবসার ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী?

মোস্তাফিজ আহমেদ: ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেপ্রথমত ভৌত অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ-সংযোগ বেশ ব্যয়বহুল। নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি প্রণোদনা ও সহযোগিতার অভাব আছে। এ কারণে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। নারকেল একটি কৃষিপণ্য। যার বাইপ্রোডাক্ট ছোবড়া থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে আমরা দেশে–বিদেশে বিক্রি করি। কিন্তু ১৫ বছরেও এটি ‘কৃষিশিল্প’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। শ্রমঘন শিল্প হওয়ার পরও এ খাতে সরকারের নজর কম। অথচ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামে এ ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ফলে তাঁরা দ্রুত বিশ্ববাজার দখল করছেন, কিন্তু আমরা পরছি না।

প্রথম আলো: বাগেরহাটের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কী?

মোস্তাফিজ আহমেদ: বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো না। এ অঞ্চলে কৃষিনির্ভর বিভিন্ন ধরনের কারখানা হওয়ার সুযোগ ছিল। যাতে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হতো। এ অঞ্চলের অনেক ছেলেমেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম গিয়ে ৮-১০ হাজার টাকায় চাকরি করছেন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে কাজের সুযোগ থাকলে তাঁরা এলাকায় থেকে কাজ করতে পারতেন। তাতে এ অঞ্চলের চেহারাই বদলে যেত। কিন্তু বাগেরহাটে শ্রমঘন শিল্পকারখানা না থাকায় কর্মসংস্থানের তেমন কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। একসময় খুলনা ছিল শিল্পনগরী। বর্তমানে এখানকার পাটকল, কাগজ কল, হার্ডবোর্ড মিল—সবই বন্ধ। যার কারণে কোনো পশ্চাৎপদ শিল্পও গড়ে উঠছে না। যা ছিল, উল্টো তা–ও বন্ধ হয়ে গেছে।

একটা সময় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ‘এক জেলা, এক পণ্য’ কর্মসূচির। তখন বাগেরহাটকে নারকেল পণ্য উৎপাদনের জন্য বাছাই করা হয়। একসময় এ জেলায় নারকেল তেলের ৪০টির মতো কারখানা ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ জেলায় নারকেল আসত। পরে সেখান থেকে তেল তৈরি করে তা সারা দেশে বাজারজাত করা হতো। এখন অধিকাংশ তেল কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রথম আলো: এ অঞ্চলে কেন বড় এবং নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না?

মোস্তাফিজ আহমেদ: যেকোনো শিল্পকারখানার জন্য দুটি জিনিস দরকার। একটি কাঁচামাল, অন্যটি বাজার। এখানে বড় শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে যেমন কাঁচামালের স্বল্পতা রয়েছে, তেমনি পণ্যের বাজারও সীমিত। এ অঞ্চলে একটি বন্দর থাকার পরও খুব বেশি আমদানি-রপ্তানিকারক না থাকায় বন্দরটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমার কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি হয়। কিন্তু এক মাস ধরে জাহাজস্বল্পতার কারণে উৎপাদিত পণ্য গুদামে পড়ে আছে। আশা করছি, পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে।

প্রথম আলো: তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও শিল্পকারখানা স্থাপনে কী ধরনের পদক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন?

মোস্তাফিজ আহমেদ: এ অঞ্চলে তরুণদের কর্মসংস্থানের বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি মনে করি, শিল্প স্থাপনে শুল্ক ও করসুবিধা দেওয়া হলে তাতে শুধু নারকেলনির্ভর শিল্পেই এ জেলায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি বন্দরকেন্দ্রিক কিছু নতুন বিনিয়োগের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কৃষিনির্ভর বিভিন্ন কলকারখানা ছাড়াও ইলেকট্রনিকস, ফার্নিচার, গার্ডেনিং ফার্নিচার, টাইলসসহ বিভিন্ন শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এসব খাতে নতুন বিনিয়োগ এলে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটবে। তবে আমি মনে করি, চাকরি খোঁজার পরিবর্তে তরুণেরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন।

প্রথম আলো: মোংলা বন্দরের সুবিধা থাকার পরও কেন এ অঞ্চলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না?

মোস্তাফিজ আহমেদ: এই বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম কম হওয়ায় জাহাজ আসে কম। কম জাহাজ আসার কারণে পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে ভাড়া বেড়ে যায়। দেশে বন্দরসুবিধা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। কিন্তু তৈরি পোশাক কারখানার বেশির ভাগই ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। তাই বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম বন্দর। মোংলা বন্দরকে পুরোপুরি মাত্রায় কার্যকর করতে হলে ব্যবসায়ীদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।