এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার

নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো হচ্ছে না শাস্তিও পাচ্ছে না কেউ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট ও দ্য ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ যৌথভাবে ২০১০ সালে কৃতী ব্যাংকার নির্বাচিত করে এম শাহজাহান ভূঁইয়াকে। ২০১২ সালে অবসরে যাওয়া এই ব্যাংকার প্রাইম ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন। দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।
এম শাহজাহান ভূঁইয়া
এম শাহজাহান ভূঁইয়া

প্রথম আলো: ৬৫ বছর পর্যন্ত ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কেমন চলছে দেশের ব্যাংক খাত?

এম শাহজাহান ভূঁইয়া: ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের চর্চা দিন দিন কমছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পথ দেখায়। বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আর সেই ভূমিকায় নেই। বর্তমানে যা হচ্ছে, তাতে নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা উচ্চপর্যায়ের ইঙ্গিত ছাড়া কিছু হচ্ছে না। ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের দায়িত্বে ছিলাম, তখনকার অবস্থা এত খারাপ ছিল না। তখন অন্যায় করে মাফ পাওয়া যেত না। কাউকে না কাউকে শাস্তি পেতে হতো। তখন তো ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণে এত ব্যবস্থাও ছিল না। গ্রাহকের ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) অনলাইন হয়নি। এখন মনে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো হচ্ছে না, তাই শাস্তিও পাচ্ছে না কেউ।

প্রথম আলো: এ জন্যই কি ব্যাংক খাত নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে?
এম শাহজাহান ভূঁইয়া: ব্যাংক খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, পরিচালক, ব্যাংকার, গ্রাহক—সবারই ভূমিকা আছে। যার যে ভূমিকা, তারা সেই ভূমিকা পালন করছে না। এ জন্য খাতটি নিয়ে এত আলোচনা। ব্যবসায় শতভাগ সফল হওয়া যায় না, কিন্তু ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী তো সফল হন। এই ৮০ শতাংশের মধ্যেও যখন অনেকে ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না, তখনই সমস্যা তৈরি হয়। তাঁকে ধরতে যখন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, তখন সমস্যা বাড়ে। ভালো গ্রাহকেরাও টাকা পরিশোধের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। যাঁরা এভাবে দেশের ক্ষতি করেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আটকে দিতে চান, তাঁদের সঙ্গে কারও সমঝোতা করা উচিত নয়। তাঁরাই দেশের প্রকৃত শত্রু। এতে পরবর্তী প্রজন্মও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনকানুন এখন আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হয়েছে। সমস্যা হলো, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা ঠিকমতো হচ্ছে না।

প্রথম আলো: সম্প্রতি খেলাপি ঋণ আদায়ে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুযোগের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আগেও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এতে কী ব্যাংক খাতের সমস্যার সমাধান হবে?
এম শাহজাহান ভূঁইয়া: কোন প্রেক্ষাপটে ও কাদের এসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা বিবেচনা করতে হবে। দেখতে হবে, যাঁদের ঋণে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের আসলে ব্যবসা থেকে আয় আছে কি না। সরকারকে কর দিচ্ছে কি না। যদি আয় থাকে, কিন্তু কর না দেয়—তাহলে বুঝতে হবে ঝামেলা আছে। আগে একটা সুযোগ ছিল, এখন আরেকটা দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু আগের সুবিধা পাওয়া ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত দেননি, সেহেতু নতুন সুযোগও কাজে আসবে বলে মনে হয় না। সমস্যার প্রকৃত রূপ খুঁজে বের করতে হবে। মতলববাজি না করে মন দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাঁরা সুবিধা নিচ্ছেন এবং যাঁরা দিচ্ছেন, উভয় পক্ষকেই মতলববাজি বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি সমস্যার সমাধান আছে। জাতি ও দেশের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা খারাপ ঋণ অবলোপন করে ফেলছি। এ ঋণের কোনো করও দেওয়া হচ্ছে না। ফলে প্রভাবশালীরা এ সুবিধা বেশি নিচ্ছেন।

প্রথম আলো: ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারের সঙ্গে বসে ঠিক করে দিচ্ছে মালিকপক্ষ। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

এম শাহজাহান ভূঁইয়া: যাঁরা এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁরা ব্যাংকের মালিক। তাঁদের ব্যাংকগুলোই এটা বাস্তবায়ন করেনি। অথচ তাঁদের অনেকেই নিজের ঋণে সুদ কমিয়ে নিয়েছেন। এমন দ্বিমুখী নীতি কেন? যা সিদ্ধান্ত নেবেন, আন্তরিকতার সঙ্গে করেন। যে জাতি পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদ ঠিকানায় রেখে যায়, তারাই সবচেয়ে সভ্য জাতি। এ থেকে প্রজন্ম কী শিক্ষা নিল। এভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।

প্রথম আলো: বর্তমানে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। সমস্যা কি শুধুই এটা, না আরও বড়?

এম শাহজাহান ভূঁইয়া: বর্তমানে ব্যাংক খাতে তদারকি খুবই দুর্বল। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। যার যে দায়িত্ব তা পালন করছে না। এ কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে ঘোষণার চেয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি। দেখা যাচ্ছে, আমদানিতে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো সুদের জন্য তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমদানি পণ্য সাত দিনেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বড় ধরা খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুদের জন্য ব্যাংক অনেক সময় গ্রাহককে সময় দেয়, গ্রাহক সেই টাকা অন্য খাতে নিয়ে যায়। আর টাকা অন্য খাতে চলে গেলে তার ওপর ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এমন ঋণ যে কত, তা বলা কঠিন। এক ঋণ যে কতবার কত নামে রূপান্তর হয়, তার ঠিক নেই। কতবার যে পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন হয়, তারও তদারকি নেই। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ও আসল সমস্যা যে কত বড়, তা জানতে বড় ধরনের গবেষণা করতে হবে। তবে সমস্যা শুধু দেড় লাখ কোটি টাকার না, এটা নিশ্চিত।

প্রথম আলো: এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কী ভূমিকা নেওয়া উচিত?

এম শাহজাহান ভূঁইয়া: বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সব তথ্য আছে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই পুরো খাত ঠিক করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদেরও সাহসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। শুধু চাকরি মনে করে দায়িত্ব পালন করলে হবে না। বিচক্ষণ ও দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য সরকারের সহায়তা সবচেয়ে বেশি দরকার। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সব পক্ষেরই ভূমিকা আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনীতির কী অবস্থা ছিল। আর এখন অর্থনীতির আকার কত বড়। সবাই কাজ করেছে, এ জন্যই এত বড় হয়েছে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে। আমরা প্রতিবছর বিদেশ থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা পাচ্ছি। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে এ টাকা আসছে। এ টাকা দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।

প্রথম আলো: পুরো খাতের নাজুক অবস্থা সত্ত্বেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন অব্যাহত আছে। আরও ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কি?

এম শাহজাহান ভূঁইয়া: বাজারে থাকা ব্যাংকগুলো ঠিকমতো চললে আরও নতুন ব্যাংক আসতে পারে। কিন্তু পুরোনো ব্যাংকগুলোই তো চলতে পারছে না। তাদের অনেকের ঋণপত্র বিদেশি ব্যাংক গ্রহণ করছে না। এ অবস্থায় নতুন ব্যাংক আনার মানে কী। ব্যর্থ ব্যাংকের পাল্লা ভারী করে কি লাভ। যাঁরা ব্যাংক চাইছেন, তাঁদের বলা হোক, পুরোনো ব্যাংকগুলো ঠিক থাকলে দেওয়া হবে।

প্রথম আলো: বর্তমানে ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে মালিকদের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?

এম শাহজাহান ভূঁইয়া: অনেক দেশেই শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংকের পরিচালনায় থাকেন না। বাংলাদেশে শেয়ারধারীরাই পরিচালক থাকার জন্য বেশি উঠেপড়ে লাগেন। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ খারাপ হয়ে গেলে পরিচালকেরা মূলধন জোগান দেবেন, এমন বিধান করা যেতে পারে। কারণ, তাঁরাই ঋণ অনুমোদন দিচ্ছেন। তাঁদের সিদ্ধান্তেই চলছে পুরো ব্যাংক খাত। এখন তো পেশাদার ব্যাংকারদের দিন শেষ হয়ে আসছে। এ জন্য ধরে নিতে পারি, প্রতিবছর ১ শতাংশ ঋণখেলাপি হতে পারে। আমেরিকা, সুইজারল্যান্ডেও অনেক ব্যাংক চলতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশে চালাতে না পারলেও কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হবে না। কারণ, সবাই সবার ভাই। দেখা যাচ্ছে, কেউ টাকা ফেরত দিচ্ছেন না, তা–ও হিসাবে নেই। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, না হলে আরও খারাপ হয়ে যাবে। আর না, সবার এ কথা বলে জেগে ওঠার সময় এসেছে।