প্রায় তিন হাজার বছর ধরে, যখনই মানুষ অর্থের কথা ভেবেছে, তখনই তা স্পর্শ করতে চেয়েছে। অর্থাৎ সব সময়ই মানুষ অর্থ বলতে নগদ অর্থই বুঝে এসেছে। কিন্তু সেই বাস্তবতার পুরোটাই এখন ক্রমে বদলে যাচ্ছে। গত এক দশকে বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল লেনদেনের জয়জয়কার দেখা যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হয়তো কিছুদিন পর নগদ অর্থের জায়গা হবে জাদুঘরে!
নানা ধরনের লেনদেনে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইলের ব্যবহার এখন একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়। ধনী দেশগুলোতে নগদ অর্থের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমছে। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতেও নগদ অর্থের ব্যবহার কমছে। বিশ্বব্যাপী নগদ অর্থ ব্যবহারের পরিমাণ ২০১৩ সালে ছিল ৮৯ শতাংশ। বর্তমানে এটি কমে হয়েছে ৭৭ শতাংশ। ব্লুমবার্গের করা নিউ ইকোনমিক ফর্ম সার্ভে অনুযায়ী, বিশ্বজুড়েই নগদ অর্থের ব্যবহার কমে যাওয়ার হিড়িক লেগেছে।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নরওয়ে বা ডেনমার্কের মতো দেশগুলোতে প্রতি পাঁচটি লেনদেনের চারটিতেই নগদ অর্থ ব্যবহার করা হয় না। প্রায় তিন বছর আগ থেকেই দেশগুলোতে এমন অবস্থা। সুইডেনে ব্যক্তিপ্রতি নগদ অর্থের লেনদেনের পরিমাণ গত ১০ বছরে কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। নরওয়েতে মোট কেনাবেচার মাত্র ৬ শতাংশ হয় নগদে। নরডিক অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় চার থেকে ছয় বছর পিছিয়ে আছে যুক্তরাজ্য। ইউকে ফিন্যান্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেদেশে এখন মাত্র ৩৪ শতাংশ লেনদেন হয় নগদ অর্থে। ওদিকে নরডিক অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে আছে ১০ বছরের মতো।
>ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা
*নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি নেই
*অর্থের দ্রুত ও নিরাপদ হস্তান্তর
*আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সাশ্রয়
*লেনদেনের প্রতিটি ধাপ চিহ্নিত
*অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ করা যায়
তবে ধনী দেশগুলোর বলয়ের বাইরে গেলে দেখা যাবে, এখনো নগদ অর্থের কদর রয়েছে। কিন্তু সেখানেও নগদ অর্থের একাধিপত্য পড়ে গেছে হুমকিতে। চীনে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ ২০১২ সালে ছিল মোটে ৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশে। ভারতেও সরকারের পক্ষ থেকেই ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তাতে ফলও মিলছে।
কিন্তু কেন নগদ অর্থ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে? ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের ডিজিটাল জীবনযাত্রার সঙ্গে লেনদেনকে মেলাতে চায়। আর এই চাহিদার কাছেই হেরে যাচ্ছে নগদ অর্থ। আবার একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি এবং ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের প্রসারও এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নরওয়ে ও ডেনমার্কে প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে এবং এই পরিস্থিতি দেশ দুটিতে নগদ অর্থের ব্যবহার কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মোবাইল ফোন নির্ভর লেনদেন ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জিএসএমএ মোবাইল ইকোনমির ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ইউনিক মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ৫৯০ কোটিতে পৌঁছাবে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার হিসাবে তা প্রায় ৭১ শতাংশ। আর মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সবার শীর্ষে আছে ভারত, চীন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। মোবাইল ফোনের প্রসারের ফলে মানুষ মোবাইলভিত্তিক ডিজিটাল লেনদেনের আওতাভুক্ত হতে পারছে। যেমন চীনে এরই মধ্যে ‘মোবাইল ওয়ালেট’ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
আগে নগদ অর্থের একাধিপত্যের যুগে ব্যাংক বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নানা ধরনের অবকাঠামো পুষতে হতো, রাখতে হতো অজস্র কর্মী। এখন তা পুষিয়ে দিচ্ছে ইন্টারনেট, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার, সার্ভার ইত্যাদি। ফলে অবকাঠামো ও কর্মী ধরে রাখার ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ থেকে সরে আসতে পারছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নগদ অর্থের ব্যবহার কমিয়ে বেশি ঝুঁকছে ডিজিটাল লেনদেনের দিকে। আবার নগদ অর্থের উৎপাদন, বাজারে সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণও ব্যয়বহুল। এক হিসাবে দেখা গেছে, ধনী দেশগুলোতে মুদ্রা উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাজারে সরবরাহের পেছনে মোট জিডিপির প্রায় ০.৫ শতাংশ খরচ হয়। কিন্তু ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় সেই হ্যাপা নেই, সুরক্ষিতও বেশ। আবার ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় ব্যবহারকারী ও দোকানপাটে অর্থ চুরির আশঙ্কাও কম থাকে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষে কর আদায় করাও সহজ হয়। কারণ ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড থাকে। ফলে কর ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কেউ অর্থায়ন করলেও তার রেকর্ড দেখে পালের গোদা খুঁজে পাওয়া যায়।