নগদের মালিকানায় যুক্ত হচ্ছে ডাক অধিদপ্তর। এটি ছিল গতকালের সংবাদের শিরোনাম। খবর অনুযায়ী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ গত মঙ্গলবার নগদের মালিকানা নির্ধারণের বিষয়ে সভা করেছে। এই সভায় ডাক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (রেজেসকো) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই সভাতে সিদ্ধান্ত হয় যে নগদ পরিচালনায় নতুন করে ‘নগদ বাংলাদেশ পিএলসি’ নামে পৃথক কোম্পানি গঠন করা হবে। এর মালিকানার ৫১ শতাংশ আসবে ডাক অধিদপ্তরের অধীনে আর ৪৯ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে থাকবে। এ জন্য আলাদা যে কোম্পানি হবে, সেটির পরিচালনা পর্ষদ হবে ৯ সদস্যের। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ পাঁচজন হবেন সরকারের প্রতিনিধি, বাকি চারজন বেসরকারি খাতের।
নগদের প্রতিষ্ঠা ২০১৮ সালে। এত দিন বলা ছিল, ‘নগদ ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেন’। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে নতুন করে ডাক বিভাগ নগদের মালিকানায় কী করে যুক্ত হচ্ছে? তাহলে এত দিন নগদের মালিকানায় কে বা কারা ছিলেন?
মূলত, নগদকে সরকারের ডাক অধিদপ্তর সেবা হিসেবে প্রচার করা হলেও এর মালিকানায় ডাক অধিদপ্তরের কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু মুনাফার ভাগাভাগিতে ডাকের নাম ব৵বহার করছে নগদ। আবার আর্থিক সেবা দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেই নগদের। এই অবস্থায় নগদের সেবাকে আইনি কাঠামোর আওতায় এনে এটাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বর্তমানে নগদের পুরো মালিকানা বেসরকারি খাতের হাতে। আগে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান নগদের মালিকানায় ছিল, যার শেয়ারধারী ছিল অনেকে। এখন থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নাম পরিবর্তন করে নগদ লিমিটেড হয়ে গেছে, যার সেবার নামও নগদ। ফলে এখন নগদ লিমিটেডে যাদের শেয়ার রয়েছে, তাদের মালিকানার অংশ অর্ধেক কমে যাবে।
নগদ ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, নগদ লিমিটেডে এখন পরিচালক ৯ জন, যাঁরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের একজন করে নাগরিক রয়েছেন। অন্য ছয়জন বাংলাদেশি।
আরজেএসসির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, নগদের শেয়ার থাকা একটি কোম্পানির মালিকানায় রয়েছেন সরকারদলীয় দুই সাংসদ নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। আর নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ, জুনিয়র চেম্বার সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ ও জুনিয়র চেম্বার ঢাকার সাবেক সভাপতি মারুফুল ইসলাম রয়েছেন নগদের শেয়ার থাকা একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়। এর মধ্যে নিয়াজ মোর্শেদ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তাঁরা তিনজনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ও একসঙ্গে এর বাইরে অনেক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। নগদের বাইরে অন্য কোম্পানিতেও তাঁরা একসঙ্গে পরিচালক পদে আছেন।
বর্তমানে নগদের পরিচালক পদে আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ, তিনি টি এশিয়া হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি। প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এমডি ও নগদের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাহেল আহমেদ ১ জুলাই থেকে ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের প্রতিনিধি হিসেবে নগদের পরিচালক। ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালক হয়েছেন সাফায়েত আলম। তিনি নগদের নির্বাহী পরিচালকও।
নথিপত্রে দেখা গেছে, ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংয়ের প্রকৃত মালিক সরকারদলীয় দুই সাংসদ নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এর মধ্যে রাজী মোহাম্মদ ফখরুল চেয়ারম্যান ও নাহিম রাজ্জাক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দুজনের দুই হাজার করে শেয়ার রয়েছে ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংয়ে।
জানা গেছে, এর বাইরে নগদের পরিচালক হিসেবে আছেন রেজাউল হোসেন, তিনি ১ জুলাই থেকে পরিচালক হয়েছেন ফিনটেক হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে। আবার ফিনটেক হোল্ডিংয়ের মালিকানা নিয়াজ মোর্শেদ ও নাসির উদ্দিনের। মারুফুল ইসলাম সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন এই দুজনের কাছে।
তবে মারুফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আমিনুল হক নগদের পরিচালক হিসেবে আছেন টেলিকম এশিয়া হোল্ডিংয়ের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে। সিঙ্গাপুরের কোম্পানি নিবন্ধনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ফিনক্লুশন ভেঞ্চার ও টেলিকম এশিয়া একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান।
এর বাইরে নগদে ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের পক্ষে সিঙ্গাপুরের নাগরিক ফয়সাল আহসান চৌধুরী ও স্টালওয়ার্ট লিমিটেডের পক্ষে কানাডার নাগরিক তামজিদ রহমান পরিচালক। আর মিয়ার্স হোল্ডিংয়ের পক্ষে পরিচালক হন ব্রিটিশ নাগরিক গিলস এলাস্টার জেমস ফার্লে, যাঁর কার্যালয় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে।
এদিকে নগদ গ্রাহকদের জমা থাকা টাকার ওপর যে ব্যাংকঋণ নিয়েছে ও বন্ড ছেড়ে টাকা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, তার কোনো দায় ডাক অধিদপ্তর নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি শেয়ার নিতে কোনো অর্থও দেবে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, ব্যাংকঋণ সমন্বয় না হলে অনুমোদন দেওয়া হবে না।
এ নিয়ে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সিরাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগদ শুরু থেকে আমাদের ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে। এর মূল্যমান হিসেবে নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা পাবে ডাক অধিদপ্তর। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মতো চলবে নগদ।’
২০১৬ সালে মোবাইলে আর্থিক সেবা দিতে গড়ে ওঠে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নগদের মালিকানায় তানভীর আহমেদের পাশাপাশি যুক্ত হন গ্রামীণফোন ও গুগলের সাবেক কর্মকর্তা কাজী মনিরুল কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সৈয়দ আরশাদ রেজা ও মিজানুর রহমান। ২০১৭ সালে ডাক অধিদপ্তরের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার কাজ নেয় থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ কার্যক্রম শুরু করে নগদ। নগদের কার্যক্রম শুরুর আগেই অংশীদারদের কেউ কেউ থার্ড ওয়েভের শেয়ার ছেড়ে দেন। এর মধ্যে কাজী মনিরুল কবির ছেড়ে দিলে মালিকানায় যুক্ত হন দুই সাংসদ নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এ ছাড়া নতুন করে মালিকানায় যুক্ত হন রেজওয়ানা নূর, পরে তিনিও ছেড়ে দেন।
মোবাইলে আর্থিক সেবায় (এমএফএস) বিকাশের পরই এখন নগদের অবস্থান। সেবাটির মাধ্যমে দৈনিক ৭০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। সহজে হিসাব খোলার সুবিধা ও ব্যবসার কৌশলের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সেবাটি। পাশাপাশি বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের গ্রাহকদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাহক করার সুযোগ পেয়েছে নগদ। ফলে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি গ্রাহক নিবন্ধন নিয়েছেন নগদের।