১৯৭১ সালের সেই বৈঠকের পর প্রভাবশালী দৈনিক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এলেই ‘বাস্কেট কেস’ বলা শুরু করে। যেমন, বাংলাদেশের খাদ্যসংকট ও খাদ্য–সাহায্য নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর যে সম্পাদকীয় লিখেছিল, তার শিরোনাম ছিল ‘বাস্কেট’। আবার বাকশাল কায়েমের পর ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল, ‘ওয়ান ম্যান’স বাস্কেট কেস’।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকবে না। এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ হয়েছিল নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশ আগে ছিল নিম্ন আয়ের দেশ। অথচ একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়েই অনেকের সংশয় ছিল। এমনকি বিজয় লাভের আগেই বাংলাদেশকে বলা হতে থাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বা বাস্কেট কেস।
শুরুতেই তলাবিহীন ঝুড়ি হওয়ার গল্পটা বলি। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা। আলোচনা হচ্ছিল বাংলাদেশ নিয়েই। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ডেভিড প্যাকার্ড, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড, সিআইএর পরিচালক রিচার্ড হেলমস, আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ও জাপানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউ এলেক্সিস জনসন, ইউএসএআইডির উপপ্রশাসক মরিস উইলিয়ামস এবং ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন।
সভায় আলোচনা হচ্ছিল মূলত পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে। বিশেষ করে মার্চে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট হবে, দুর্ভিক্ষও হবে—এ বিষয়গুলো নিয়ে। একপর্যায়ে বৈঠকের কথোপকথন ছিল এ রকম—
কিসিঞ্জার: পূর্ব পাকিস্তানে কি দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা আছে?
মরিস উইলিয়ামস: সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে, তাদের প্রচুর ফসল আছে।
কিসিঞ্জার: তাহলে কি আগামী বসন্তের পরে?
উইলিয়ামস: হ্যাঁ, যদি না তারা মার্চের মধ্যে নিজেদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না নিতে পারে।
কিসিঞ্জার: আমাদের তখন খাদ্য–সহায়তা পাঠাতে হতে পারে?
উইলিয়ামস: হ্যাঁ।
কিসিঞ্জার: তাহলে এ ব্যাপারে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত।
উইলিয়ামস: মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের আরও অনেক ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
জনসন: সেটা হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস।
কিসিঞ্জার: হ্যাঁ, তবে শুধু আমাদের বাস্কেট কেস না।
বলা যায়, সেই থেকেই বাস্কেট কেস বা তলাবিহীন ঝুড়ি কথাটা বাংলাদেশের হয়ে যায়। অর্থাৎ, দেশটিতে যে সাহায্য দেওয়া হোক, তা ঝুড়ির ফুটো দিয়ে পড়ে যাবে। এরপর থেকে দীর্ঘ বছর পর্যন্ত প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশকে বলা হতো বাস্কেট কেস। তবে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলার জন্য এককভাবে হেনরি কিসিঞ্জারকে দায়ী করলেও আসলে কথাটা তাঁর নিজে ছিল না। কথাটা আসলে ইউ এলেক্সিস জনসনের। তবে হেনরি কিসিঞ্জার এতে সায় দিয়েছিলেন।
সেই হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে বাংলাদেশের একদল সাংবাদিকের দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালে, সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে।
সেই হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে বাংলাদেশের একদল সাংবাদিকের দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালে, সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেই সাংবাদিক দলে আমিও ছিলাম। সম্মেলনের প্রথম দিন। মাত্রই সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছেছি, ঢুকেই দেখি দাঁড়িয়ে চেরি ব্লেয়ার, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী। হঠাৎ দেখি বার্তা সংস্থা ইউএনবির শামীম আহমেদ (বর্তমানে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার) উল্টো দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। লিফটের ঠিক সামনে তখন হেনরি কিসিঞ্জার। সুযোগটি ছাড়লেন না শামীম আহমেদ। সামনে দাঁড়িয়েই হেনরি কিসিঞ্জারকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘বাংলাদেশকে মনে আছে আপনার? সেই যে আপনি বাস্কেট কেস বলেছিলেন। এখন কী বলবেন?’ প্রশ্নটি শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে কিসিঞ্জার উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিশেষ এক সময়ের পরিস্থিতিতে এ কথা বলেছিলাম। এখন আর সে বিষয়ে কোনো কিছু বলতে চাই না।’ কথা আর সেদিন এগোয়নি।
১৯৭১ সালের সেই বৈঠকের পর প্রভাবশালী দৈনিক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এলেই ‘বাস্কেট কেস’ বলা শুরু করে। যেমন, বাংলাদেশের খাদ্যসংকট ও খাদ্য–সাহায্য নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর যে সম্পাদকীয় লিখেছিল, তার শিরোনাম ছিল ‘বাস্কেট’। আবার বাকশাল কায়েমের পর ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল, ‘ওয়ান ম্যান’স বাস্কেট কেস’।
তবে বাংলাদেশকে যে আর তলাবিহীন ঝুড়ি বলা যাবে না, এ কথা প্রথম লেখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনামেই ছিল ‘বাংলাদেশ, “বাস্কেট কেস” নো মোর’।
বলে রাখা ভালো, ‘বাস্কেট কেস’ শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহার করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। আহত যেসব সৈনিকের পা কাটা গিয়েছিল, ছিল না হাত, অপরের কাঁধে ছাড়া চলার শক্তি ছিল না, তাদের বলা হতো বাস্কেট কেস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আবার তা ব্যবহার করা হয়। তারও পরে আহত সৈন্য বাদ দিয়ে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বলা শুরু হলো। আর ১৯৭১ সালে এর ব্যবহার শুরু হয় সদ্য স্বাধীন একটি দেশের ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কবে থেকে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে রেহাই পেল। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ নজরে আসতে শুরু করে গত দুই দশকে। এরশাদ পতনের পরে বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদ শুরু হলেও নব্বইয়ের দশকের সংস্কারের ফল পেতে অপেক্ষা করতে হয় পরের এক দশক পর্যন্ত।
তবে বাংলাদেশকে যে আর তলাবিহীন ঝুড়ি বলা যাবে না, এ কথা প্রথম লেখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনামেই ছিল ‘বাংলাদেশ, “বাস্কেট কেস” নো মোর’।
দুর্বল গণতন্ত্র, আইনের শাসনের অভাব, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা, দুর্বল প্রতিষ্ঠান—এসব বিষয়ে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বদরবারে আলোচনা-সমালোচনা আছে। এর মধ্যেও তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বিস্ময়কর উত্থান বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে।