ছোট সংকেত কি বড় বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ কোন পথে যাচ্ছে? ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ কোন পথে যাচ্ছে? ছবি: রয়টার্স

কাজ শুরুর আগে কয়লাখনির শ্রমিকেরা কি করেন জানেন তো? খনিটি বিপদমুক্ত কি না, তা খুব প্রাচীন একটি পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে নেন। খনিতে আগে ক্যানারি পাখি প্রবেশ করান তাঁরা। ওই খনিতে যদি সামান্য বিষাক্ত গ্যাসও থাকে তাহলে হলদে রঙের ছোট্ট পাখিগুলো মারা পড়ে। আর তা দেখেই খনির কর্মীরা বুঝে যান এটি বিপজ্জনক। এশিয়ার বাণিজ্য গবেষকেরাও এখন অর্থনীতিকে এভাবে বিশ্লেষণ করছেন। ছোট ছোট সংকেত থেকে সামনের বড় বিপদটাকে বোঝার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

শুরুটা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবারই অভিযোগ তুলছিলেন তাঁর বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছে, যা তিনি আর হতে দিতে পারেন না। এরপরই শুরু হয়ে যায় শুল্ক-পাল্টা শুল্কের তির ছোড়াছুড়ি।

গত বছরের মে মাসে চীন থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় এমন বেশ কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছিলেন ট্রাম্প। এরপর চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। শুরু হয়ে যায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ, যা এখনো কোনো সফল উপসংহারে পৌঁছায়নি। এতে দুই দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা স্পষ্টতই বলা যায়। সেই সঙ্গে এই দুই দেশের সংঘাতের মধ্যে জাঁতাকলে পড়ে গেছে সিঙ্গাপুরের মতো অনেক দেশ। আর এর জন্য তাদের কত ক্ষতি হচ্ছে, এখন সেই অঙ্ক কষতেই তারা ব্যস্ত।

সম্প্রতি নিজেদের প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানির অবস্থান তুলে ধরেছে সিঙ্গাপুর। গত বছরের চেয়ে এ বছরের জুনে সিঙ্গাপুরে রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। শুধু তা–ই নয়, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ, এটা বলা যেতেই পারে যে বিশ্বব্যাপী সিঙ্গাপুরের পণ্য বিক্রি কমে গেছে। শহরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রটি বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির একটি। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সূচকে এই রাষ্ট্রের অবদান অনেক।

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ছবি: রয়টার্স

বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কিছুর শুরুটা দেখলেই বোঝা যায় বাকিটা কেমন হবে। সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক তথ্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেমন প্রভাব পড়তে যাচ্ছে সারা এশিয়াতে। সামনে যে বিপদ আসছে, তা এই পরিসংখ্যানই তা নির্দেশ করছে।

সাম্প্রতিক সময়ের সব তথ্য–উপাত্ত এমন নির্দেশই দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ অশনিসংকেত হয়ে আসছে এশিয়ার জন্য। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতিবিদ সং সেং উন বলেন, পুরো অঞ্চলেই একই ঘটনা ঘটছে। ১০ বছর ধরে স্থিতিশীল থাকার পর যখন বিশ্ব প্রবৃদ্ধি কিছুটা শ্লথ গতিতে আছে, তেমন সময়েই এই বাণিজ্যযুদ্ধের শুরু। এখন কোনো অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে বাণিজ্যযুদ্ধের অবসান হলেও যা ক্ষতি হয়েছে, তার প্রভাব অনেক ব্যাপক।

গত জুন কেবল সিঙ্গাপুরের জন্য নয়, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যও কোনো সুখবর আনেনি। জুনে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত ৯ মাসের মধ্যে এতটা কমেনি রপ্তানি। চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার হলো ইন্দোনেশিয়া। জুনে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দেশটির রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। এই দেশগুলো পামতেল থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর চিপ, কেমিক্যাল বিক্রি করে চীনে।

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধির হার প্রকাশ করেছে চীন। এতে দেখা গেছে, গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশটিতে। এপ্রিল-জুন মাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এর মূল কারণই হলো বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হওয়া শঙ্কা। চীন থেকে আমদানি করা প্রায় অর্ধেক পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে চীনের কোম্পানিগুলোকে তাদের ক্রেতাদের জন্য পণ্যের দাম কমাতে হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রিই কমিয়ে দিতে হবে। তাই এই দ্বৈরথে উলুখাগড়ার মতো বহু দেশ জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের ১২০টি দেশের শীর্ষ আমদানি উৎস হচ্ছে চীন। দেশটির ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সঙ্গে বহু দেশ যুক্ত হয়েছে। এই যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি পক্ষকে বেছে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে দেশগুলোর সামনে। এ ক্ষেত্রে বড় সংকটের সৃষ্টি হবে। কারণ, বাণিজ্য শক্তির জায়গা থেকে চীন ব্যাপক প্রভাবশালী হলেও রাজনীতি-অর্থনীতি দুই বিবেচনাতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। ফলে দীর্ঘ সংকটাবস্থার সৃষ্টি হবে।

জুনে সিঙ্গাপুরে রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ছবি: রয়টার্স

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ইন্দোনেশিয়ায় পামতেলের রপ্তানি কমেছে। ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের শীর্ষ পামঅয়েল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশ। মূলত গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এটা কমতে শুরু করে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সব মিলিয়ে ২৯ লাখ টন অপরিশোধিত পামতেলের রপ্তানি হয়, যা আগের মাসের তুলনায় ৩ শতাংশ কম। গত নভেম্বরে দেশটি থেকে মোট ৩০ লাখ টন পামতেল রপ্তানি হয়েছিল। সেই হিসাবে এক মাসে দেশটি থেকে পামঅয়েল রপ্তানি কমেছে এক লাখ টন। এর অর্থ হচ্ছে, বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের কারখানায় পণ্য সরবরাহকারী দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে শিগগিরই এই পরিস্থিতি বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। জাপানের গবেষণা সংস্থা নোমুরা চলতি সপ্তাহে এশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হচ্ছে, সামনের মাসগুলোতে এশিয়ার দেশগুলোর রপ্তানিতে মন্দা থাকবে। আর এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার কোনো অগ্রগতি না হওয়াকে দায়ী করছে তারা। তারা বলছে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতিই এশিয়া অঞ্চলের জন্য প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ অবস্থায় আসলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী হতে যাচ্ছে? এর উত্তরে কোনো নির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যাবে না। আগামী প্রজন্মের কোম্পানি ও ভোক্তাদের মূল বাজার হচ্ছে এশিয়া। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৫২ শতাংশই নির্ভর করবে এশিয়ার ওপর। অর্থাৎ এটা বলা যায়, বিশ্বপ্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হবে এশিয়া। তবে এই বাণিজ্যযুদ্ধ চলতে থাকলে ইতিহাস অন্য রকমও হতে পারে।