নিজের একটি ফ্ল্যাট। মধ্যবিত্তদের কাছে এ যেন স্বপ্নের মতো। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদি আবাসন ঋণ দিয়ে একটি স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করছে। এর ফলে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারছেন। আবার অনেকে এক হয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে বাড়িও নির্মাণ করছেন।
আবাসনে ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন আগের চেয়ে বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আবেদন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ঋণ অনুমোদন দিচ্ছে, আবার কেউ নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ আবেদন নিষ্পত্তি করছে।
আগে ব্যাংকগুলো ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারত। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দুই কোটি টাকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (লিজিং কোম্পানি) আগে থেকেই গ্রাহকদের চাহিদামতো ঋণ দিতে পারছে।
ফ্ল্যাট কেনা ও বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশনও (বিএইচবিএফসি) ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। সে অনুযায়ী বাড়ি নির্মাণে একজন ব্যক্তি এখন দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। আর গ্রুপ করে ঋণ নিলে প্রতিজনে পাবেন ১ কোটি ২০ লাখ টাকা করে। এদিকে ফ্ল্যাট কেনার জন্যও বিএইচবিএফসি থেকে গ্রাহকেরা ১ কোটি ২০ লাখ টাকা করে ঋণ পাবেন।
ঋণ বিতরণের পাশাপাশি ঋণ প্রক্রিয়াটিও আগের চেয়ে অনেক সহজ করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন ঋণ দিতে ছুটছে গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। শহর ছাড়িয়ে আবাসন ঋণ মিলছে এখন শহরতলি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও।
ব্যাংক বা বিএইচবিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে ৩০ শতাংশ টাকা নিজের থাকতে হয়। অর্থাৎ এক কোটি টাকার ফ্ল্যাট কিনতে প্রতিষ্ঠানগুলো ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়। বাকি ৩০ লাখ টাকা ক্রেতার নিজের থাকতে হয়। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্ল্যাটের দামের পুরোটাই ঋণ হিসেবে দিতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিএইচবিএফসির ঋণের সুদহার ৭ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদহার ৯ থেকে ১৩ শতাংশ। আবাসনে ঋণ দিতে এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নামে ঋণপণ্যও বাজারে রয়েছে।
ব্যাংকগুলো অনেক আগে থেকেই আবাসনে ঋণ দিয়ে এলেও ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইএফআইসি ব্যাংক প্রথম কম সুদে গৃহঋণ নিয়ে বড় প্রচারে আসে। এরপর অন্য ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ঋণদাতা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এ পথে হাঁটতে শুরু করে। শুরুতে আইএফআইসি ব্যাংক ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ বিতরণ করে। ওই সময় অন্য ব্যাংকগুলোতে এ খাতে বিতরণ করা ঋণের সুদের হার ছিল ১৫ শতাংশের বেশি। পরে একই বছরের ডিসেম্বরে গৃহঋণের সুদের হার কমিয়ে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ নির্ধারণ করে আইএফআইসি ব্যাংক। তবে বর্তমানে এ সুদহার কিছুটা বেড়ে ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
জানা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও এ খাতে মনোযোগ দিচ্ছে। সোনালী ব্যাংক গ্রামাঞ্চলে বাড়ি নির্মাণে ‘সোনালী নীড়’ নামে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের ‘আমার বাড়ি’ নামে আলাদা একটি পণ্য রয়েছে। বাড়ি নির্মাণে দুই কোটি টাকা দিলেও ব্যাংকটি সেমিপাকা ভবন নির্মাণে দিচ্ছে ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ। ডাচ্–বাংলা ব্যাংক চালু করেছে ‘ঠিকানা’ নামের আলাদা ঋণ প্রকল্প।
আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যোগ্য হলে এখন সহজেই আবাসন ঋণ মিলছে। আবাসন ঋণ নিরাপদ হওয়ায় ব্যাংকগুলো বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। আইএফআইসি ব্যাংক প্রথম সুদহার কমিয়ে এ খাতকে উজ্জীবিত করেছে। আমরা এখনো আগের মতো ঋণ দিয়ে যাচ্ছি।’
ডেলটা–ব্র্যাক হাউজিং (ডিবিএইচ) গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে। ন্যাশনাল হাউজিং ঋণ দিচ্ছে ফ্ল্যাট কেনা, নিজের বাড়ি নির্মাণ, বাড়ি বর্ধিতকরণ, প্লট কেনা, বাণিজ্যিক ভবনে জায়গা কেনা ইত্যাদি খাতে।
ডিবিএইচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিউ এম শরীফুল আলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি আবাসনে ঋণ দিয়ে আসছি। এর মাধ্যমে গ্রাহকেরা নিজের একটি বাড়ি পাচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে ফ্ল্যাট কিনতে ঋণ দিচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। ব্যাংকটি ফ্ল্যাট কিনতে এরই মধ্যে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। তবে আবাসনে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ডিবিএইচ, প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সুদহার সাড়ে ১১ শতাংশ। আর ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। আইএফআইসি ৪৮ ঘণ্টায় ঋণের আবেদন নিষ্পত্তি করছে। তাদের সুদ হার ১০ শতাংশ।
আবাসন ঋণে ব্র্যাক ব্যাংকের সুদহার সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে শুরু। আবাসনে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। এ খাতে সিটি ব্যাংকের ঋণের সুদ হার ১২ শতাংশ, ঋণ দিয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়ার আবাসন খাতের ঋণের সুদহার সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে শুরু। ঋণ দিয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এর বাইরে আইডিএলসি, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সও আবাসনে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে।
নথিপত্র যা লাগবে
বাড়ি নির্মাণ ঋণের জন্য প্রথমেই দরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত নকশার সত্যায়িত ফটোকপি। মূল দলিল, নামজারি খতিয়ান, খাজনা রসিদের সত্যায়িত ফটোকপি। এ ছাড়া লাগবে সিএস, এসএ এবং আরএস, বিএস খতিয়ানের সত্যায়িত কপি। জেলা বা সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে ১২ বছরের তল্লাশিসহ নির্দায় সনদ (এনইসি)। সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া জমির ক্ষেত্রে মূল বরাদ্দপত্র এবং দখল হস্তান্তরপত্রও লাগবে।
ফ্ল্যাট ঋণের জন্য অবশ্য কাগজপত্র কম লাগে। এ জন্য ফ্ল্যাট ক্রেতা এবং ডেভেলপারের সঙ্গে সম্পাদিত ফ্ল্যাট ক্রয়ের রেজিস্ট্রি করা চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি দিতে হবে। এ ছাড়া জমির মালিক এবং ডেভেলপারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি, অনুমোদিত নকশা ও অনুমোদনপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি এবং ফ্ল্যাট কেনার রেজিস্ট্রি করা বায়না চুক্তিপত্রের মূল কপি এবং বরাদ্দপত্র লাগবেই।