>বিগত কয়েক বছরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেক আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর এ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রায় এক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।
সরকারের প্রথম কাজ ব্যাংক খাত ঠিক করা
প্রথম আলো: ব্যাংক খাত নিয়ে এত আলোচনা, আপনাদের দৌড়ঝাঁপ। আসল সমস্যাটা কী?
নজরুল ইসলাম মজুমদার: ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা খেলাপি ঋণ। দেশের ব্যাংক খাতের ১২-১৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, তা আদায় করা যাচ্ছে না। এসব ঋণ কীভাবে আদায় করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। জোর করে, মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে তো এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না। প্রভাবশালী যে–ই হোক না কেন, ব্যাংকের টাকা তো ফেরত দিতেই হবে। তারা টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে, সরকার তো বসে থাকবে না। ব্যাংক খাত ঠিক করা এখন সরকারের প্রথম অ্যাজেন্ডা।
প্রথম আলো: এত নিয়ম–কানুন, নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ব্যবস্থা—এরপরও কেন খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটিতে পৌঁছাল?
নজরুল ইসলাম মজুমদার: বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ীরা খেলাপি হয়ে গেছেন, কেউ পণ্যমূল্য ওঠানামার কারণে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না। কিন্তু আগে নিয়মিত ঋণ শোধ দিতেন। আবার মালিক মারা যাওয়ার কারণেও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসা করতে গেলে টাকা লাগে, খেলাপি হয়ে পড়ায় অনেককে ব্যাংক সময়মতো টাকা দেয়নি। আবার অনেক সময় বেশি মুনাফার আশায় চাহিদার বেশি টাকা দিয়েছে ব্যাংক। সামান্য কিছু টাকার কারণেই হয়তো অনেকে খেলাপি হয়ে পড়েছে।
আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। তারা আয়েশি জীবন কাটাচ্ছে, কিন্তু ব্যাংক বিপদে পড়ে গেছে। তাদের কীভাবে ধরা যায়, এ নিয়ে কাজ হবে। আর যারা বিপদে পড়ে টাকা দিতে পারছে না, তাদের কোনোভাবে টেনে তোলা যায় কি না, এ নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে একতরফাভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেছে, বিষয়টা তেমন নয়। ব্যাংকও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়ী।
প্রথম আলো: খেলাপি ঋণ আদায়ে আপনাদের দিক থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন?
নজরুল ইসলাম মজুমদার: নতুন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খেলাপি ঋণ আর বাড়তে দেওয়া যাবে না, কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেছেন, যাঁরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না, তাঁদের সঙ্গে প্রথমে আলোচনার মাধ্যমে ভদ্রভাবে টাকা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি এমন সামাজিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তাঁরা টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। আবার যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের নতুন করে অর্থায়ন করে টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। আবার কারও জন্য অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন বিভিন্ন আইনের পরিবর্তন। আমাদের আইনপ্রণেতারা চাইলেই সেটা সম্ভব। এখন অনেক ঋণখেলাপি আদালত থেকে আদেশ নিয়ে নিজেকে ঋণখেলাপির বাইরে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন। এসব সুযোগ বন্ধ করা প্রয়োজন।
প্রথম আলো: ব্যাংক খাত ঠিক হয়ে যাবে, এ বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
নজরুল ইসলাম মজুমদার: আমরা ভালো কিছু আশা করছি। নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে, নিশ্চয়ই অনেক ভালো সিদ্ধান্ত আসবে। যারা টাকা নিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই তা জেনে সরকার বসে থাকবে না। খেলাপিরা এখন নির্বাচন করতে পারে না, নিশ্চয়ই তাদের বিষয়ে আরও বড় সিদ্ধান্ত আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও ব্যাংকগুলোকে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। খেলাপি ঋণ অনেক হয়ে গেছে, আর বাড়তে দেওয়া যায় না। সময় এসেছে ভালো কিছু করার। এসব সমাধান হলেই ঋণ ও আমানতের সুদহার কমে যাবে। তবে সুদহার বেঁধে দেওয়ার বিষয় নয়। জোগান ও চাহিদার ওপর সুদের হার বাড়বে-কমবে। ইউরোপের মতো আমাদেরও সুদহার কমানোর সুযোগ আছে। দেশে যেভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সেই অনুযায়ী ব্যাংক খাত ঠিক করতেই হবে। অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে ব্যাংকের অনেক অবদান। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনাও উন্নত করতে হবে। প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে।
ঋণখেলাপিদের বড় ধাক্কা দিতে হবে
প্রথম আলো: ব্যাংক খাত নিয়ে এত আলোচনা। এ খাতের আসল সমস্যাটা কী?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এখন খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া মানে আমরা যে টাকা বিনিয়োগ করেছি, তা আটকে যাওয়া। এর নানামুখী প্রভাব আছে। এ বিনিয়োগের জন্য ব্যাংককে কর দিতে হয়। সুদ স্থগিত থাকে, আবার এ জন্য ব্যাংককে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। এর ফলে ব্যাংকের মুনাফা কমতে থাকে। আবার এ টাকা ব্যবহারের মধ্যে না থাকায়, নতুন করে ঋণ দেওয়া যায় না। ফলে আমানতের ওপর চাপ পড়ে। এতে করে ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি হয়, মূলধনেও চাপ পড়ে। এটা একটা চক্রের মতো। পুরো ব্যাংকই খেলাপি ঋণের কারণে চাপে পড়ে যায়।
প্রথম আলো: তাহলে এ খাতের প্রধান সমস্যা এখন খেলাপি ঋণ। এ খেলাপি ঋণ কমানোর উপায় কী?
মাহবুবুর রহমান: খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় করা যায়, এটাই এখন বড় বিষয়। এর মধ্যে অনেক ঋণ আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছে। মামলার কারণে যেসব ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না, তা কীভাবে আদায় করা যায়—এটা গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বিচার বিভাগের কাছে আমাদের কিছু চাওয়া রয়েছে। অর্থঋণ আদালতকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, হাইকোর্টে বিশেষ ডেস্ক নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। চীনে ঋণখেলাপিদের বিমানে ওঠায় নিষেধাজ্ঞা আছে, নেপালের মতো দেশে ঋণখেলাপিরা পাসপোর্ট সুবিধা পান না। এসব দেশ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এখন সময় এসেছে খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আমাদেরও এমন বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে সহজে সমস্যা কাটবে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণ আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। যারা খেলাপি, তাদের কারও শাস্তি হলেই সবাই সতর্ক হবে। অর্থঋণ, সার্টিফিকেট মামলা আইনে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আমরা জেলা পর্যায়েও অর্থঋণ আদালত চাই। সরকার চাইলে সবই সম্ভব। সরকার এখন খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে চাইছে। মনে হচ্ছে, আমরা ভালো কিছুর দিকেই যাচ্ছি।’
প্রথম আলো: দক্ষ ব্যাংকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অর্থ মন্ত্রণালয়—এত কিছুর পরও কেন এত ঋণ খেলাপি হলো?
মাহবুবুর রহমান: স্বাধীনতার পর সব ব্যাংক জাতীয়করণ করা হলো। ১৯৮৩ সালে বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। তখন কোনো আইন–কানুনই ছিল না। এ সময়ে ঋণ খারাপ হওয়া শুরু করে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নীতিমালা তৈরি করল। তখন সরকারি ব্যাংকই বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। অনভিজ্ঞতা, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাসহ নানা কারণেই খেলাপি ঋণ তৈরি হলো। তখন কেউ টাকা ফেরত না দিয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন, এর ফলে টাকা ফেরত না দেওয়ার একটা সংস্কৃতি চালু হয়ে গেল। একসময় সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ অনেক কম ছিল। সরকারি ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলে বেসরকারি ব্যাংকের টাকা কেন দিতে হবে, পরে এমন মনোভাব চলে এল। আবার অনেকেই নানান ছাড় নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পরে টাকা শোধ করছেন। আবার যিনি নিয়মিত শোধ করছেন, তিনি কোনো ছাড় পাচ্ছেন না। ফলে ব্যবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে, নিয়মিত ঋণ শোধ করা ভালো গ্রাহকের জন্য এটা একধরনের শাস্তি। এ জন্য পদ্ধতিগত বড় পরিবর্তন আনতে হবে। ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের শাস্তি দিতে হবে, অথবা সামাজিকভাবে তাঁদের একঘরে করতে হবে। তাতে তাঁরা একটা বড় ধাক্কা খাবেন, সবাই সতর্ক হবেন। এ ধাক্কাটা দিতেই হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী মুনাফার প্রবণতার কারণেও যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলেও অনেক ঋণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: আমরা যে বড় অর্থনীতির দিকে যাচ্ছি, তাকে সমর্থন দিতে ব্যাংক খাত কি প্রস্তুত?
মাহবুবুর রহমান: আমরা বড় অর্থনীতির দিকে যাচ্ছি, ৭ শতাংশের ওপরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এটা ধরে রাখতে বিনিয়োগ লাগবে। আর বিনিয়োগের বড় অংশ যাবে ব্যাংক থেকে। এ জন্য প্রয়োজন আমানত ও ব্যাংকের মূলধন। আমানতের প্রধান উৎস হলো মানুষ। বিনিয়োগ আসছে খুবই কম, প্রবাসী আয় সেভাবে বাড়ছে না। এ জন্য আমাদের দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে হবে। সামনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের চাপ আসবে। সরকারও ঋণ নেওয়া শুরু করেছে। এ কারণে আমানতের সুদের হার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে ঋণের সুদের হারও বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, ব্যবসায় সহজ করার সূচকে উন্নতি করতে হবে।