রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশন রোডের কাজী লিয়াকত আলীর কথা কি মনে আছে কারও? ৪০ বছরের টগবগে এক যুবক ছিলেন তিনি। ছিল ফুটফুটে এক শিশুকন্যা। নাম তার মনীষা। ছিল বলছি, কারণ অনেক কিছুই এখন অতীত। শিশুকন্যা মনীষা এখন কিশোরী। আর লিয়াকত না–ফেরার দেশের বাসিন্দা।
লিয়াকত ও মনীষার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শেয়ারবাজার। শুধু আছে বলাটা ভুল; থাকবে আরও বহুদিন। কারণ, এ শেয়ারবাজার কেড়ে নিয়েছে লিয়াকতকে। আর মনীষাকে সাড়ে চার বছর বয়সে করেছে পিতৃশূন্য। শেয়ারবাজারের লোকসান বইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন লিয়াকত।
সেটি ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি। ওই সময় দেশের সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল লিয়াকতের আত্মহত্যার ঘটনাটি। তখন অসহায় ওই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল দেশের অনেকে; শুধু শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রকদের সহানুভূতি মেলেনি। দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই সেই পরিবারের সঙ্গে। তবে সময়ের হিসাব বলছে, লিয়াকতের রেখে যাওয়া শিশুসন্তান মনীষা এখন ১৩ বছরের কিশোরী। নিশ্চয় বাবাকে খোঁজে, জানতে চায় বাবার মৃত্যুর কারণ। কী উত্তর দেন তার মা তাহমিনা আকতার?
মা হয়তো স্বভাবজাতভাবে অনেক কিছু লুকান সন্তানের কাছ থেকে। কিন্তু মনীষা নিশ্চয় এখনকার প্রজন্মের মতোই প্রযুক্তিপ্রেমী। হাতের মুঠোফোনটি নিয়ে বাবার নাম দিয়ে গুগল করলেই মনীষার জেনে যাওয়ার কথা তার বাবার মৃত্যুর কারণ। মনীষার কাছে তার বাবা হারানোর কষ্ট ও দুঃখের মোড়ানো এক নাম ‘শেয়ারবাজার’। মনীষার মতো আরও লাখ লাখ কিশোর-কিশোরীর কাছেও তা–ই। কারণ, এ শেয়ারবাজার ওই সব পরিবারের জন্য বোবাকান্নার নাম।
২০১২ সালের পর ২০২০ সাল। এ শেয়ারবাজার নিয়ে বোবাকান্না থামে না তবু বিনিয়োগকারীর পরিবারে। কারণ, বাজারে প্রাণ নেই, গতি নেই। আছে কেবল পুঁজি হারানোর ভয়। নেই সুশাসন, নেই বিনিয়োগকারীর আস্থা। এত এত ‘নেই’-এ ভরা বাজারে সুশাসন ও বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে যেন গতকাল মঙ্গলবার এক কড়া বার্তা দিলেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নবগঠিত কমিশন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গতকালের সভায় কয়েকটি কোম্পানি, হিসাব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইস্যু ব্যবস্থাপককে জরিমানা করা হয়েছে। এ জরিমানার পরিমাণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানভেদে অপরাধ বিবেচনায় সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা। যেসব অপরাধে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এ জরিমানা করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিরই কারণ ছিল। গতকালের সভাটি ছিল নতুন কমিশনের চতুর্থ কমিশন সভা।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন নেতৃত্বের শুরুতে এমন পদক্ষেপে বাজার–সংশ্লিষ্টদের মনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। বিএসইসি জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত হতে চাওয়া আল ফারুক ব্যাগ নামের কোম্পানিটি যে নিরীক্ষকের কাছ থেকে সনদ নেওয়ার কথা ছিল, সেটি নেয়নি। উল্টো বিধিবদ্ধ নিরীক্ষকের কাছ থেকে সনদ নিয়েছে। এ ভুল করার পরও ইস্যু ব্যবস্থাপক সবকিছু ঠিক আছে মর্মে প্রত্যয়ন করেছেন। এ কারণে কোম্পানিটির পরিচালক, ইস্যু ব্যবস্থাপক ও নিরীক্ষক—সবাইকে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করা হয়।
এ ছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি এম আই সিমেন্ট তার পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিধিবহির্ভূতভাবে মোট অঙ্কের সুদবিহীন ঋণসুবিধা দিয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থহানি ঘটেছে। তাই কোম্পানিটির স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালক ছাড়া অন্য সব পরিচালককে ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইনটেক লিমিটেডের অপরাধ আরও গুরুতর। ব্যবসার কথা বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছিল কোম্পানি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সেই টাকায় কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেও সেই ‘মূল্য সংবেদনশীল তথ্য’ বিনিয়োগকারীদের দেয়নি। আবার সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ ও ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশ ন্যূনতম শেয়ার ধারণের শর্তও মানেননি কোম্পানিটির পরিচালকেরা। এ জন্য স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালক ছাড়া অন্য সব পরিচালককে ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
আইনি ধাপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি এ জরিমানার টাকা আদায় হয়, তবে তা জমা হবে বিএসইসির তহবিলে। যেই তহবিলের টাকা বিএসইসির কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধার পেছনে খরচ হবে। কারণ, বছর বছর তা–ই হয়ে আসছে। যেসব বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে কোম্পানিগুলো নয়ছয় করেছে, সেই বিনিয়োগকারীদের ভাগে কিছুই জোটে না। কোম্পানিগুলোয় টাকা বিনিয়োগ করার পর সেই কোম্পানিগুলো তাদের ঠকায় নানাভাবে। বিনিয়োগের বিপরীতে না পায় প্রত্যাশিত লভ্যাংশ। আবার বাজারেও মেলে না প্রত্যাশিত মূলধনী মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইন। কারণ, বাজারেও সুশাসন নেই। কোম্পানিগুলোর পর্ষদ যেমন নয়ছয় করে বিনিয়োগকারীর টাকায়, তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় বাজারেও চলে নয়ছয়।
নতুন কমিশন এসে শুরুতেই বাজারে কড়া বার্তা দিতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। আপাতত এ পদক্ষেপের জন্য তাঁরা প্রশংসা পেতেই পারেন। তবে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাকিয়ে আছেন বাজারের দিকে। প্রাণহীন, গতিহীন ও আস্থাহীন বাজার। সেই আস্থাহীনতা দূর করে বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করা এ নতুন কমিশনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে উতরাতে হলে সবার আগে দরকার বাজারের সুশাসন। বিএসইসির গতকালের পদক্ষেপ বাজারের সুশাসন ও বিনিয়োগকারীর আস্থা প্রতিষ্ঠায় কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।
শুরুর ভালো কি শেষ ভালো? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, না। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদ্য বিদায়ী খাইরুল হোসেন কমিশনই তার প্রমাণ। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর ২০১১ সালে দায়িত্ব নেন খাইরুল হোসেন। দায়িত্ব নিয়ে ওই বছরই ন্যূনতম শেয়ার ধারণের আইন করে বেশ বাহবা পেয়েছিলেন বাজার–সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। যদিও ওই আইন আদর্শ বাজারকাঠামোর বিপরীত। তবু ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ ভেবে মেনে নিয়েছেন সবাই তা; যেমন করে শেয়ারের ‘সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইজের’ বর্তমান বিধানকে মেনে নেওয়া হচ্ছে। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার এ সময়ে মনীষার মতো আরও অনেক কিশোর-কিশোরীও যেন শেয়ারবাজারে পুঁজি হারানো তাদের পরিবারের দুঃখ-দুর্দশাকেও মেনে নিয়েছে। মেনে নিলেও তো আর আক্ষেপ বা বাসনা থেমে থাকে না। তাই লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পরিবার বাজার ভালো হবে—এ আশায় আছে। সেসব অপেক্ষমাণ মলিন মুখের কিশোর-কিশোরী ও তাদের পরিবারের মুখে কি হাসি ফিরিয়ে দিতে পারবে বর্তমান শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা? তারা প্রত্যাশা করে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার শুরুর ভালো যেন সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে না যায়। ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’। তাই শেষ ভালোর অপেক্ষায় মনীষার মতো লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী ও তাদের পরিবার।