সংবাদ বিশ্লেষণ

কেবল পর্যবেক্ষক নিয়োগই সমস্যার সমাধান নয়

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটি ১৯৯৯ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, ‘সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মালিক, গ্রাহক ও নিয়ন্ত্রকের ত্রিমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় সার্বিকভাবে এসব ব্যাংকের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।’
এরও আগে বিশ্বব্যাংক ১৯৯৬ সালে ‘বাংলাদেশ: যে কাজ করতে হবে’ নামের একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত একটি অশুভ চক্রের হাতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ব্যাংকসমূহ সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের বিপুল পরিমাণ নন-পারফর্মিং ঋণ থেকে কোনো অর্থ উপার্জন করছে না। দুর্বল ও জবাবদিহিবিহীন ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য কিছুই করছে না। আর সরকার ব্যাংকের মালিক, গ্রাহক, নিয়ন্ত্রক ও ঋণ আদায়ের জন্য আইন কাঠামো প্রদানকারীর পরস্পরবিরোধী ভূমিকার আবর্তে বাঁধা পড়েছে।’
এ নিয়ে এর পরেও অনেক কথা হয়েছে। এমনকি ঋণ নিয়ে প্রকল্পও করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো যাতে নিজেরাই চলতে পারে, এ জন্য কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এখন আর রাষ্ট্রায়ত্ত বলা হয় না, বলা হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে ভালোভাবে চালানোর জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিদেশি পরামর্শক, তাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে বহু গুণ। এই সবকিছুর ফলাফল হচ্ছে, গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।
বাংলাদেশ এ কাজটি করতে বাধ্য হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশ সফর শেষ করেছে এ সপ্তাহেই। সফর শেষে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে যে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। আর এর এক দিন পরেই নিয়োগ দেওয়া হলো চার পর্যবেক্ষক।
দেশের ব্যাংক খাতে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ২২ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, খেলাপি ঋণের এই হার অস্বাভাবিক বেশি।
এমনিতেই দেশে ব্যাংকঋণে সুদের হার অনেক বেশি। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, উচ্চ সুদ হারের কারণে অনেক উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। আর ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, শুধু খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারলেই অন্তত ২ শতাংশ সুদ কমানো সম্ভব হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, পর্যবেক্ষক নিয়োগই কি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জন্য সমাধান? এমনটি কেউ মনে করেন না। কারণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো আজ যে এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার মূল কারণ সরকারের একের পর এক ভুল নীতি। এসব ব্যাংক চালানো হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়; যা কিছু সংস্কার, তা হয়েছে মূলত দাতাদের চাপে ও অর্থে। তবে সবশেষ সর্বনাশটি হয়েছে ২০০৯ সালের পর ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। এরপরই হল-মার্কসহ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। ব্যাংকগুলো চালাতে হবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে। তদারকির দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করতে হবে পর্ষদ। প্রতিটি আর্থিক কেলেঙ্কারির সঠিক বিচার করতে হবে। এসব না করে কেবল পর্যবেক্ষক নিয়োগে দীর্ঘদিনের জমানো সমস্যার সমাধান হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামোতে ঝামেলা রয়েছে। পর্যবেক্ষক বসিয়ে সেটাকেই স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পর্যবেক্ষক ব্যাংকের পর্ষদ সভা ও নিরীক্ষা-সংক্রান্ত সভায় বসবেন, দেখবেন, কথা শুনবেন। তাঁরা পর্ষদে মতামত দেবেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সুপারিশ করবেন। যদি এমন হয় যে তাঁদের কথা শুনলে শুনল, না শুনলে না শুনল; তাহলে পর্যবেক্ষক বসিয়েও কাজ হবে না। কোনো অনিয়ম থাকলে দ্রুততম সময়ে নির্ভয়ে, সততার সঙ্গে বলতে হবে। আর পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়মিত তদারকিতে রাখতে হবে।