কালোটাকা কেন সাদা হয় না? এ প্রশ্ন অহরহ শুনতে হয়। আরেকটি জনপ্রিয় প্রশ্ন হচ্ছে কালোটাকা তো তেমন সাদা হয় না, তাহলে সরকার বারবার সুযোগ দেয় কেন?
তাহলে একটা গল্প বলি। যুদ্ধে চরম পরাজয় ঘটেছে। রাজা সেনাপতিকে প্রশ্ন করলেন, যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ কী? সেনাপতি বললেন, পরাজয়ের ১০১টা কারণ আছে। রাজা একটা একটা করে শুনতে চাইলেন। সেনাপতি শুরু করলেন, ‘হুজুর, প্রথম কারণ হচ্ছে আমাদের হাতে তো অস্ত্র ছিল। কিন্তু কোনো গুলি ছিল না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে...।’ এ পর্যন্ত বলতেই রাজা সেনাপতিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থাক আর দরকার নাই। যুদ্ধে হারার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট।’
সুতরাং কেন কালোটাকা সাদা হয় না, আপনারা যদি এর কারণ শুনতে চান, তাহলে আমিও ১০১টার কথা বলতে পারি। আর যদি একটা কারণ জানতে চান, তাহলে উত্তর হচ্ছে ‘কালোটাকা সাদা হয় না, কারণ কালোটাকার মালিকেরা ভয় পায় না।’
এখন একজন কালোটাকার মালিককে যদি একই প্রশ্ন করেন, আর যদি পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘টাকা সাদা করব না, কী করবেন?’ তাহলে কিছু কি বলার আছে? আর এরপর কি আর কোনো প্রশ্ন করা চলে?
কালোটাকার মালিকেরা কিন্তু একবারই খানিকটা ভয় পেয়েছিলেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একবার কালোটাকা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন অর্থ, পরিকল্পনা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ছিলেন এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
২০০৭ সালের জুন মাসে মাত্র দুই মাসের জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয় আর তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার কর্মসূচি। ওই বছরের ৪ জুন জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘গত কর বর্ষ থেকে আগের পাঁচ কর বর্ষ পর্যন্ত সময়ে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি তাদের অপ্রদর্শিত আয় বা বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট কর বর্ষের জন্য নির্ধারিত আয়কর এবং ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে বৈধ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত জমি, দালান, গাড়ি, ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ ও কোম্পানির শেয়ার বৈধ করা যাবে।’
এ সুযোগ ছিল ৩১ জুলাই পর্যন্ত। পরে অবশ্য আরও দুই মাস বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বলা ছিল, এরপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিশেষ টিম অনুসন্ধানে নামবে এবং কারও অঘোষিত আয় খুঁজে পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ জরিমানা করা হবে। সেই ভয়ে বেশ কিছু মানুষ তাঁদের অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করে নিয়েছিলেন। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল। আর এতে বৈধ হয় ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা এবং সরকার রাজস্ব পায় ৬৮৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
পুরোনো কথাই যখন বললাম, তখন আরও একটু পেছনে যাই। দেশে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। সে সময় ৬ নম্বর সামরিক আইনের অধীনে ‘কর-অনারোপিত আয়ের’ ঘোষণার জন্য ১৯৭৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আর ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সে সময়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আশা করা যায় যে করদাতারা তাঁদের এখনো অপ্রকাশিত আয় ঘোষণার এই শেষ সুযোগ হারাবেন না। কেননা, এর পরে কর ফাঁকির ব্যাপারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এরপর থেকে প্রায় সব সরকারই অবাধে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, নানা ধরনের হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব হুমকি কেবল বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে তেমন কেউ উৎসাহ দেখায়নি। তবে দুটো ব্যতিক্রম ঘটনার কথা বলাই যায়। যেমন এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে অর্থমন্ত্রী হন এম সাইফুর রহমান। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কালোটাকা বৈধ করার যে ধরনের বৈষম্যমূলক কর দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে এ ধরনের গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীস্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি আমাদের এই গণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ পরিহার করবে।’ পরের পাঁচ অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করার আর সুযোগই দেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয় ব্যতিক্রম ঘটনাটি ২০০৯ সালের। সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেটের আগে তিনিও ঘোষণা দিলেন আর কালোটাকা সাদার সুযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু বাজেট ঘোষণায় ঠিকই এ সুযোগ দেওয়া হলে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ফলে এর ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল তাঁকে। বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমঝোতা। কেননা, রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল। রাজনীতিতে সব ধরনের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়। এ হচ্ছে রাজনীতির কাছে নৈতিকতার পরাজয়।’
সাবেক অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর অবশ্য কেন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়, এ প্রশ্ন আর না করাই ভালো। তবে ঝামেলাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। আর সেটা হচ্ছে সুযোগ তো দেওয়া হয়, কিন্তু তেমন কেউ সাড়া দেয় না। প্রশ্ন হচ্ছে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
এক সরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তার কথা বলি। বেনামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক। তিনি নিজে সেই ফ্ল্যাটের কিস্তির কোনো অর্থ পরিশোধ করেননি।
আসলে তিনি নিজের হাতে কিছু করেন না। এমনকি ঘুষের টাকাও হাতে নেন না। যিনি বা যাঁরা ঘুষ দেবেন, তাঁরাই নিজ দায়িত্বে ফ্ল্যাটের কিস্তি জমা দিয়ে আসেন। এখন আপনারাই বলেন, আগ বাড়িয়ে তাঁর এসব ফ্ল্যাট বৈধ করার কী দায় পড়েছে? তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খাতায় কেন নাম লেখাবেন? সেখান থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনও তো জেনে যেতে পারে বা অন্য কোনো সংস্থা। কিন্তু এমনিতে তো তাঁকে কেউ ধরতে আসছে না। কালোটাকা সাদা করলে কোনো শাস্তিও নেই। ভাগ্য খুব বেশি খারাপ না হলে কোনো ভয়ই নেই। তাহলে কীভাবে কালোটাকা সাদা হবে?
শুরুর কথাটা আবারও বলি। ‘কালোটাকা সাদা হয় না, কারণ কালোটাকার মালিকেরা ভয় পায় না।’
এরপরও কি কেউ কালোটাকা সাদা না হওয়ার বাকি ১০০টা কারণ জানতে চাইবেন?