ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালি নিয়ে এখন নানা সমালোচনা। বড় সমালোচনা হচ্ছে কিছু মানুষের লোভ নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, লোভই কি একমাত্র দায়ী? অথচ ইভ্যালি নিয়ে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলছে না। উত্তর পেলে অনেক কিছুই জানা যেত, কে বা কী দায়ী—এ নিয়ে অনেক প্রশ্নেরই সমাধান হয়ে যেত।
২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস। দিনটির সঙ্গে এ দেশের মানুষের আবেগ জড়িত। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি কার্যক্রম শুরুর জন্য এই বিশেষ দিনটিকেই বেছে নিয়েছিল। এর পরের দুই বছর নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়েছে তারা। ইভ্যালি নিয়ে প্রথম থেকেই কিছু গুঞ্জন ছিল। তবে তা জোরালো হয় ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে। গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়।
২০২০ সালের ২৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ইভ্যালি’। এরপর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খানিকটা নড়েচড়ে বসেছিল সে সময়। যুগ্ম সচিব আবদুছ সামাদ আল আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনও দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। তার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) চিঠিও পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরপরই, ২৭ আগস্ট ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেলের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
এরপরই নানা শঙ্কায় পড়ে ইভ্যালি। এমডি মো. রাসেলকে ফেসবুক লাইভে এসে বারবার গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে হয়েছিল। পণ্য কেনাবেচা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে চলে এক মাস। নিয়ম হচ্ছে, ব্যাংক হিসাব এভাবে স্থগিত হয়ে গেলে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ধরে নিতে হবে যে লেনদেনে কোনো সমস্যা নেই। এই নিয়ম মেনেই এক মাস পর খুলে যায় ইভ্যালির সব ব্যাংক হিসাব। সুতরাং গ্রাহকেরাও বার্তা পেয়ে যান যে কোথাও কোনো সমস্যা নেই।
ব্যাংক হিসাব খোলার দিনটি স্মরণীয় করতে মো. রাসেল কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। তারপর নতুন উদ্যমে লাইভে আসেন। গ্রাহকেরাও সরকারের পদক্ষেপে নতুন করে আশ্বস্ত হয়ে বিপুল উৎসাহে কম দামে পণ্য কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
প্রশ্ন হলো, কার ইশারায় বিএফআইইউ সেদিন ইভ্যালির লেনদেনের বিস্তারিত অনুসন্ধান না করে ব্যাংক হিসাব খুলে দিয়েছিল। প্রশ্নটা উঠছে এ জন্য যে সেই বাংলাদেশ ব্যাংকই আট মাস পর অনুসন্ধান করে ইভ্যালির লেনদেনে নানা অনিয়ম খুঁজে পায়। কিন্তু মাঝের আট মাসে প্রতারিত হন বিপুলসংখ্যক গ্রাহক।
ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার এক মাস পেরিয়েছে কিছুদিন হলো। দিনটি ছিল রোববার, ৮ নভেম্বর। ই-ক্যাবের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১০০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং ১২ ব্যক্তিকে ই-কমার্স মুভার্স অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল। কোভিড-১৯ করোনা মহামারির সময়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এই সম্মাননা দেওয়া হয়। এ সময় পুরস্কার পায় ইভ্যালির ইফুড। ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ। ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠান একসময় বাংলাদেশের আলিবাবা, আমাজন হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। আর অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ রাসেল বলেছিলেন, ‘আজকের এই ইভ্যালির পেছনে আমার অনুপ্রেরণা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন আমাকে অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে।’
ই-ক্যাবের একটি ওয়েবসাইট আছে। সেখানে নানা অনুষ্ঠানের ছবি দেওয়া আছে। সেসব দেখে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ই-ক্যাবের কোন কোন অনুষ্ঠান ইভ্যালির আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হয়েছে, তাহলে উত্তর কী হবে?
প্রথম আলোতেই প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ‘বেসরকারি খাত উন্নয়নে নীতি সমন্বয় কমিটি’ নামে একটি কমিটির সভায় ই-কমার্স নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেই সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সেই সভায় ই-কমার্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও এটুআই যৌথভাবে ‘এসক্রো সেবা’ চালু করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা পাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তার আগে জমা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের কাছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যবস্থা করেছে ঠিকই, তবে দুই বছর পর। তত দিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেবলই গাফিলতি বা আমলতান্ত্রিক জটিলতা, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সময়মতো ‘এসক্রো সেবা’ চালু করা হয়নি?