বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ প্রথম পর্যায়ের জনমিতি পার করছে। এর সুবিধা ভালোমতো নিতে আমাদের অর্থনৈতিক নীতির পাশাপাশি সামাজিক নীতিও গ্রহণ করে দুটির সমন্বয় করতে হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আর জবাবদিহি নিশ্চিতে শুধু সরকার নয়, সুশীল সমাজ ও গবেষকেরাও ভূমিকা রাখতে পারেন।
‘৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তরুণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং একশনএইড বাংলাদেশ গতকাল শনিবার এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনা সভায় সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ইশরাত শারমীন গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই পরিকল্পনা এমন সময়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে যখন দেশ করোনার কারণে সৃষ্ট আর্থসামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত সাফল্য করোনার কারণে আশঙ্কার সম্মুখীন হয়েছে। দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে জনমিতির লভ্যাংশ কাজে লাগানোর যে সুযোগ রয়েছে, তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
ইশরাত শারমীন বলেন, দেশে কর্মসংস্থানে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বর্তমানে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থান ২০১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মধ্যবর্তী সময়ে হ্রাস পেয়েছে। তৃতীয়ত, অনানুষ্ঠানিক খাতে তরুণদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারুণ্যের প্রত্যাশা থাকবে, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, বেকারদের জন্য বিমা প্রকল্প প্রণয়ন করা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে বিদ্যমান বৃত্তি প্রদান প্রকল্পগুলোর আওতা বৃদ্ধি করা।
জাগো ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক এশা ফারুক বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শ্রমবাজারের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, যার ফলে যথাযথ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হলেও তাঁরা টিকে থাকতে পারছেন না। কারণ, তাঁদের দক্ষতা থাকলেও যথাযথ অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সমাজে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে যে বিরূপ মনোভাব রয়েছে, তা পরিবর্তন জরুরি। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও কার্যকর করে তুলতে হবে। সে জন্য উন্নত মানের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা দরকার।
একশনএইড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক নাজমুল আহসান বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ইতিবাচক দিক হচ্ছে এটি অনেক স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। তবে এটির বাস্তবায়ন দরকার, না হলে বাংলাদেশ জনমিতির সুবিধা অর্জনে ব্যর্থ হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ ও তা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তুলে ধরা তথ্যগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ও তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) যুগ্ম পরিচালক ফাল্গুনি রেজা বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তরুণদের বিভিন্ন দাবির প্রতিফলন ঘটেছে। তবে সেসব বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার।
ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের অপারেশনস লিড সামাঞ্জার চৌধুরী বলেন, দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমানতালে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল। তবে গত কয়েক বছরে তেমনটা হতে দেখা যায়নি। দেশে চাকরিপ্রার্থী তৈরি হলেও চাকরি তৈরি হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটরা শ্রমবাজারের জন্য তৈরি নয়। তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
একশনএইড বাংলাদেশের নারী অধিকার ও জেন্ডার সমতার ব্যবস্থাপক মরিয়ম নেসা বলেন, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া যে স্বপ্নকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তরুণদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার বিভিন্ন অংশকে চিহ্নিত করে তাঁদের সবার চাহিদা পূরণের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য নাসিমা বেগম বলেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রয়োজন। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। সরকার এ ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। নীতিনির্ধারণে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতেও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় চেষ্টা করে যাচ্ছে। আগেই তৈরি হওয়ায় এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় করোনা পরিস্থিতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে বার্ষিক পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংযোজন করা হবে।