দুই বন্ধুর অংশীদারত্বে ঢাকার মোতালেব প্লাজায় মোবাইল যন্ত্রাংশের একটি দোকান চালান মফিজুল ইসলাম (৪৬)। ভাড়ায় দোকান। চার বছর ধরে ব্যবসা ভালোই চলছিল তাঁদের। স্ত্রীর পরামর্শে এবং পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিলেন মফিজুল। শেষ পর্যন্ত এ বছরের জানুয়ারিতে পাঁচ বছর মেয়াদে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন পরিবার সঞ্চয়পত্রে।
কিন্তু করোনাভাইরাস সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে মফিজুলদের। গত মার্চের শেষ দিকে সবকিছু যখন প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়। মুঠোফোনে সম্প্রতি মফিজুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া, সংসার খরচ, দোকানভাড়া মিলিয়ে আর কুলাতে পারছিলাম না। তাই সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেললাম। সেখান থেকে মাসে ৪ হাজার ৮০০ টাকা করে পেতাম। রেখে দিতে পারলে হয়তো লাভবান হতাম।’
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার দিনেই সঞ্চয়পত্রটি ভেঙে ফেলেন মফিজুল। তিনি আরও বলেন, সরকার সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা বললেও তিনটি ব্যাংকে যোগাযোগ করেও তিনি ঋণ চেয়ে ব্যর্থ হন। শেষমেশ তাই সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিতেই হলো।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার প্রবণতাটা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অথচ উচ্চ সুদের কারণে এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের প্রতিই মানুষের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল। কিন্তু করোনা পাল্টে দিল সব হিসাব। সংকটে পড়ে মফিজুলের মতো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা অধিকাংশ গ্রাহকই এখন সেই সঞ্চয় ভাঙিয়ে ফেলছেন। নিয়ম অনুযায়ী মাঝপথে ভেঙে ফেললে সঞ্চয়পত্রে সুদ কম পাওয়া যায় জেনেও অধিকাংশ গ্রাহক সেটাই করছেন। অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির চেয়ে ভাঙিয়ে নেওয়ার পরিমাণ এবার চার গুণের বেশি।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ১১ মাসের (জুলাই-মে) চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ১১ কোটি টাকার। হিসাবটি এ রকম—সঞ্চয় অধিদপ্তর জুলাই-মে সময়ে মোট ৫৭ হাজার ৮০৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ৪৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকেরা। তাই মোট বিক্রি থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার হিসাবটি বাদ দিলেই নিট বা প্রকৃত বিক্রির তথ্যটি বেরিয়ে আসে।
করোনাকালে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ও ভাঙানোর প্রবণতা নিয়ে জানতে চাইলে সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সামছুন্নাহার বেগম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর অনেকের বিনিয়োগের সময়সীমা শেষ হয়েছে (ম্যাচিউরড)। এখন যেহেতু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) লাগে এবং নতুন নতুন শর্তও রয়েছে, ফলে নতুন করে বিনিয়োগে অনেকেই এগিয়ে আসছেন না। আর কোভিড-১৯–এর একটি প্রভাব তো আছেই। যদিও এই পরিমাণটা বেশি হবে না। সব মিলিয়েই নিট বিক্রিটা এবার কম। তবে সরকারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা আমরা ঠিকই অর্জন করতে পারব।’
এ ছাড়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার করোনাভাইরাসের প্রভাবে অনেকেই আর্থিক সংকটে পড়েছেন। অনেকে চাকরি খুইয়েছেন। সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া মানুষগুলো তাই সংগত কারণেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। স্বাভাবিক সময়েও নিয়মিতভাবে অনেকে সঞ্চয়পত্র ভাঙান। তবে করোনাকালে এ প্রবণতা একটু বেশি।
গত তিন মাসের চিত্র
সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে গত মঙ্গলবারের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে মোট ৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর গ্রাহক ভাঙিয়েছেন ২ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তাতে যোগ-বিয়োগের হিসাবে ওই মাস শেষে প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ৪৩০ কোটি টাকায়।
এপ্রিলে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৬৬২ কোটি টাকার। ওই মাসে গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে নিয়েছিলেন ১ হাজার ১৬ কোটি টাকার। এ কারণে এপ্রিলে প্রকৃত বিক্রি ছিল ঋণাত্মক।
আর মার্চ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল মোট ৫ হাজার ৬২৪ কোটি টাকার। ওই মাসে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকার। এর ফলে প্রকৃত বিক্রি দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি ছিল ৬ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। ওই মাসে ভাঙানো হয় ৪ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তাতে ফেব্রুয়ারিতে প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ মূলত দুটি। একটি হচ্ছে, ধনী লোকেরা এখন আর সঞ্চয়পত্রে খুব বেশি টাকা রাখতে পারছেন না। অন্যটি, করোনার কারণে সাধারণ লোকের সঞ্চয়পত্র কেনার সক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ খুব কষ্টে আছেন। তাই তাঁরা এখন সঞ্চয়পত্রসহ নানা ধরনের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। তবে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ভাবলে এতে সরকারের সুদ ব্যয় কমবে।
এদিকে, সঞ্চয় অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৯০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকার। ওইবার গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে নিয়েছিলেন ৪০ হাজার ৪০৩ কোটি টাকার। তবে এবার ১১ মাসেই ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ভাঙিয়ে নিয়েছেন, যা অর্থবছর শেষে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছিল। পরে এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে করা হয় ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।