কোভিড-১৯-এ বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে। বড় অর্থনীতি না হলেও যে কটি দেশে প্রবৃদ্ধি হবে, তার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। তবে করোনায় মানুষের আয় কমেছে। ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। উৎপাদন কমেছে।
বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে সারা বিশ্ব। করোনার কারণে দেশে দেশে এই সংকট তীব্র হচ্ছে। ধনী-গরিব সব দেশেই এর প্রভাব পড়েছে। বেশির ভাগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকোচন হবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। কর্মহীন হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। এমন দুর্গতির মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশার কথাই শুনিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এমন অবস্থায় সব দাতা সংস্থাই বলছে, এত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মহামন্দায় বড় বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো বিপাকে পড়েছিল। দশকজুড়ে চলে মহামন্দা। নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতিতে আসে দুর্যোগ। আর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাত থেকে শুরু হওয়া মন্দা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু করোনার মতো এমন সর্বজনীন মন্দা আর দেখা যায়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এই মহামন্দায় বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ কোথায়, কোন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—এ নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ দেশি গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস ও মূল্যায়ন নিয়ে এবারের আয়োজন।
করোনায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশ কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এমন অবস্থায় সব দাতা সংস্থাই বলছে, এত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। অর্থনীতি আগের জায়গায় ফিরে যেতে সময় লাগবে। এ ছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কতটা গভীর হয়, এর ওপর নির্ভর করছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কতটা ত্বরান্বিত হবে। তাই ওই সব সংস্থা চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে।
আইএমএফ বলছে, চলতি ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ গায়ানা ও দক্ষিণ সুদানের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। তবে আইএমএফ এ–ও বলছে, করোনার আগের মতো ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বাংলাদেশকে আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।
৮ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনের আগাম পূর্বাভাস, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বিশ্বব্যাংক কারণ হিসেবে দেখিয়েছে, অর্থনীতিতে শ্লথগতি। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদের আয় কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে ভোগ করার প্রবণতা কমে গেছে। এ ছাড়া রপ্তানি ও প্রবাসি আয় কম হবে। আর বেসরকারি বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা আছে। তবে আগামী অর্থবছরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে। ওই বছর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছে এই দাতা সংস্থাটি।
আরেক দাতা সংস্থা আইএমএফ জিডিপি পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে সব সময় একটু রক্ষণশীল থাকে। অবশ্য এই দাতা সংস্থাটি পঞ্জিকাবর্ষ ধরে জিডিপির হিসাব করে থাকে। আইএমএফ বলছে, চলতি ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ গায়ানা ও দক্ষিণ সুদানের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। তবে আইএমএফ এ–ও বলছে, করোনার আগের মতো ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বাংলাদেশকে আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আইএমএফের এবারের পূর্বাভাস হলো, ২০২০ সালে মাত্র ২২টি দেশে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জার্মানি, জাপানের মতো দেশে জিডিপি সংকোচন হবে। এর মানে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বেশ ভালো পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তাই চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে এই দাতা সংস্থাটি। চীন, ভারত ও মালদ্বীপের পরই সবচেয়ে প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশে।
এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ৩০ দেশের মধ্যে ২৬তম। বাংলাদেশের পেছনে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান। এই তালিকায় শীর্ষে আছে তাইপে। এর পরেই সিঙ্গাপুরের অবস্থান।
প্রবৃদ্ধিতে চতুর্থ শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। আগামী বছরের শুরুতে অর্থনীতি আরও বেগবান হবে বলে মনে করে এডিবি। করোনা সংকট বেশি দিন ধরে বিরাজমান থাকলে তা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে এডিবি। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ওই ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে এডিবি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সুখ সূচকও দেখিয়েছে। সেখানে আমাদের জন্য ভালো খবর নেই।
এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ৩০ দেশের মধ্যে ২৬তম। বাংলাদেশের পেছনে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান। এই তালিকায় শীর্ষে আছে তাইপে। এর পরেই সিঙ্গাপুরের অবস্থান। বাংলাদেশের নাগরিকেরা কতটা ভালো আছেন, তা দেখা যাক। এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ১০০–এর মধ্যে ৪৩ পয়েন্ট পেয়েছে। এর মানে ভালো থাকার মানে মাঝামাঝি অবস্থানেও নেই বাংলাদেশ।
করোনার কারণে দেশে–বিদেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের পভার্টি অ্যান্ড শেয়ারড প্রসপারিটি ২০২০ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্বের অতি দারিদ্র্যের হার ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের বেশি হয়েছে। করোনায় বিপুলসংখ্যক কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে অতি দরিদ্র্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২০ ও ২০২১, এই দুই বছরে সারা বিশ্বের ১১ কোটি থেকে ১৫ কোটি লোক নতুন করে গরিব হয়ে যেতে পারেন। এর মধ্যে শুধু ২০২০ সালেই ৮ কোটি ৮০ লাখ থেকে সাড়ে ১১ কোটি লোক এমন বিপাকে পড়বেন। চলতি অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আরেক সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গরিব লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র্য হার সাড়ে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। যাঁরা দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করতে পারেন না, তাঁদের দরিদ্র হিসেবে ধরে বিশ্বব্যাংক।
করোনাকালে বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক গবেষণা আছে। সব প্রতিষ্ঠানই বলেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলেছে, গত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে দারিদ্র্য হার ১৯ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। কমবেশি ১ কোটি ৬৪ লাখ নতুন করে গরিব হয়েছেন। এ ছাড়া আগে থেকেই সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনায় দারিদ্র্য হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় এসেছে, দারিদ্র্য হার দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা।
দারিদ্র্য বেড়েছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর—করোনায় শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে। লাখ লাখ কর্মজীবী বেকার হয়ে গেছেন। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা।
পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় বেকারত্ব ওই সময়ে দশ গুণ বেড়ে যায়। আড়াই শতাংশ বেকারত্ব হার পৌঁছে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থনীতি খুলতে শুরু করায় জুলাই থেকে বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সেপ্টেম্বরে এসে বেকারত্বের হার আবার ৪ শতাংশে নেমে আসে। এত দ্রুত বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ করোনার প্রথম তিন-চার মাস যত বেকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখনো কাজ পাননি। চাকরির বাজার এখনো আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি।
পিপিআরসি ও বিআইজিডি গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার প্রথম দিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন মাসে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি ও লকডাউনের প্রভাবে গত এপ্রিল মাসে গরিব মানুষের আয় ৭৫ শতাংশ কমেছে। আর গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের আয় ৬৫ শতাংশ কমেছে।
গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে সেই তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত এপ্রিল-জুন সময়ে ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদন হয়েছে।
গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের উৎপাদন খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। সাবান, ডিটারজেন্টসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী, ওষুধসহ হাতে গোনা কয়েকটি পণ্যের উৎপাদন বাড়লেও অন্য সব শিল্পপণ্যের উৎপাদনে ব্যাপক ধস নামে। বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ ছিল কিংবা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপণ্য হিসেবে তৈরি পোশাককে ধরা হয়। এটি আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য এবং অর্থনীতির চালিকা শক্তি।
গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে সেই তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত এপ্রিল-জুন সময়ে ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে ৬৯ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার পোশাক বানানো হয়েছিল। করোনা এভাবেই আমাদের শিল্প খাতে ক্ষত চিহ্ন রেখেছে।