এত মাথাপিছু আয় দিয়ে কী করবেন

সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ায় যাঁরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের জন্য সুখবর। আপনার মাথাপিছু আয় আজ ২৩৪ ডলার বেড়ে গেছে। ডলারের হিসাবে বিভ্রান্ত হলে টাকায় হিসাবটা করা যাক। আর তা ২০ হাজার টাকার বেশি। সুতরাং সামান্য ৩৮ টাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন বরং একটু স্বাস্থ্যসচেতন হতে পারেন। সয়াবিন তেল না খাওয়াই ভালো। সূর্যমুখীর বা জলপাইয়ের তেল খেতে পারেন। দাম বেশি তাতে কী, মাথাপিছু আয় তো বেড়েছে। আবার গুণীজনের পরামর্শ মেনে বাদামের তেলও কিনতে পারেন। দাম খুব বেশি নয়, ১০০ গ্রাম মাত্র ৯০ টাকা। আপনার মাথাপিছু আয়ের তুলনায় কিছুই নয়। সুতরাং যাঁরা এত মাথাপিছু আয় দিয়ে কী করবেন ভাবছিলেন, তাঁদেরও চিন্তার কিছু নেই।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) রীতিমতো সভা করে রাতারাতি আমার-আপনার মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরেই মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার আর এখন তা ২ হাজার ৮২৫ ডলার হয়েছে। একই সময়ে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বেড়ে হচ্ছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
সারা বিশ্ব এখন মোটেই থিতু হতে পারছে না। ২০২০ সাল থেকে শুরু কোভিড–১৯–এর প্রকোপ। সেই মহামারি এখনো উধাও হয়ে যায়নি। মহামারি কেবল যে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ডেকে এনেছে তা–ই নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে করেছে বিপর্যস্ত। কোভিড যেতে না যেতেই ইউক্রেনে হামলা করে রাশিয়া। কোভিডের কারণে আগেই নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের উৎপাদন ছিল কম, সরবরাহব্যবস্থা হয়ে পড়েছিল বিঘ্নিত, ইউরোপের যুদ্ধ তা আরও প্রকট করেছে। ফলে সারা বিশ্বই এখন নতুন মন্দা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কিত।

এ রকম এক অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় একটা লাফ দিয়েছে। যদিও সরকারের এই হিসাব নিয়ে সন্দেহ আছে বরাবরের মতোই। বিনিয়োগ বাড়ছে না, সরকারের রাজস্ব আয় কম, বাড়ছে না মানুষের আয়, সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি অথচ রাতারাতি বেড়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। মানুষের মাথাপিছু এই আয় বর্তমান বাজারের প্রকৃত চিত্রের সঙ্গে কি সংগতিপূর্ণ? একনেক বৈঠক শেষে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। আর এর জবাবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম যা বলেছেন, তাকে জিডিপির ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় বলা যায়। তিনি বলেছেন, ‘গ্রামের মানুষও যে যার মতো ভালো আছে, আনন্দে আছে, আনন্দ নিয়ে বাজার করছে। তাই মাথাপিছু আয় বর্তমান বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মনে হয় আমার। আমাদের হিসাবে মাথাপিছু আয় ঠিক আছে। আয় বৃদ্ধিতে এবার ঈদে হাটবাজারে বেশি বেচাকেনা হয়েছে। গ্রামেও প্রত্যেকের হাতে মোবাইল। খালি পায়ে কেউ নেই। সবার আয় বেড়েছে।’

এবারের জিডিপি ও মাথাপিছু আয় কি চোখের দেখায় বেড়েছে, নাকি এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ আছে, তা জানা আজকাল মুশকিল হয়ে গেছে। সরকারের পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক দিন ধরেই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ছিলেন রীতি ইব্রাহীম। দেশে জিডিপির হিসাব নিয়ে বিতর্ক দেখা দেওয়ার পরে ২০২০ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তরুণ বয়সে দেখেছি, জিডিপি কত হবে, তা আগে ঠিক করা হয়। পরে “ব্যাক ক্যালকুলেশন” করে হিসাব ঠিক করা হয়।’

জিডিপির অর্জন নিয়ে প্রতিবছরই এখন বিতর্ক হচ্ছে। এই বিতর্কের অবসান হওয়া দরকার। পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ অর্থনীতির নীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেই সমস্যা বেশি হয়। জিডিপি বা প্রবৃদ্ধিই যে উন্নতির একমাত্র লক্ষণ নয়, তা ষাটের দশকেই প্রমাণ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এতে সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসছেও না। যে মাথাপিছু আয় চোখে দেখা যায় না, অনুভবও করা যায়, সেই প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে—সেটাই বড় প্রশ্ন। সন্দেহ নেই দেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে। তবে ঠিক কতটা, তার প্রকৃত চিত্রটা জানা জরুরি।