হুন্ডি কাজলের কথা মনে আছে? সেই যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বহুল আলোচিত হুন্ডি ব্যবসায়ী ফারুক আহম্মেদ কাজল ওরফে হুন্ডি কাজল। তিনি ছিলেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার সলেমানপুর গ্রামের বাসিন্দা। কাজল ১৯৯৩ সালে হুন্ডি ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সৃষ্টি করেন অসংখ্য এজেন্ট। যাঁদের মাধ্যমে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। আর হাজার হাজার মানুষ এই হুন্ডি ব্যবসায় টাকা লগ্নি করেন। হুন্ডি ব্যবসা সম্পূর্ণ বেআইনি। তারপরও হাজার হাজার মানুষ এই ব্যবসায় লগ্নি করেছিলেন কেন? কারণ, দ্রুত মুনাফা পাওয়ার লোভ।
রাস্তার ওপারে ছিল মধুমিতা সিনেমা হল, আর এপারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবন। ওপারে কালোবাজারে সিনেমার টিকিট বিক্রি আর এপারে শেয়ারের কাগজ বিক্রির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।
তবে ৯০ দশকের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির নাম ১৯৯৬–এর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। পুরোনোরা ১৯৯৬–এর মতিঝিলের রাস্তায় শেয়ার বেচাকেনার সেই দৃশ্যের কথা একবার ভাবুন। ‘বাই, সেল, বাই, সেল’—শেয়ার বিক্রির সেই দৃশ্য ছিল অনেকটা সিনেমার টিকিট বিক্রির মতোই। রাস্তার ওপারে ছিল মধুমিতা সিনেমা হল, আর এপারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবন। ওপারে কালোবাজারে সিনেমার টিকিট বিক্রি আর এপারে শেয়ারের কাগজ বিক্রির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। দ্রুত লাখপতি, তারপর লাখপতি থেকে কোটিপতি হওয়ার নেশায় তখন শেয়ারের কাগজ কিনেছে অসংখ্য মানুষ। সেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আবার দেখা দিয়েছিল ১৫ বছরের পরে, ২০১০ সালে। সময় বদল হলেও মূল বিষয় একই ছিল, নিজে ঠকে যাওয়া এবং অন্যকে ঠকানো। অর্থাৎ আবারও সেই লোভ।
বাংলাদেশে যারা মানুষ ঠকিয়েছে, তাদের ব্যবসার মূল পুঁজি আরেক দল মানুষের লোভ। লোভ সব সময়ই থাকে, তবে এই লোভকে ব্যবহার করতে জানতে হয়। এ জন্য ব্যবসার ধরনও পাল্টাতে হয়। যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) ছিল এ রকম প্রলোভনের আরেক ব্যবসা। মূলত তাদের কাজ ছিল দ্রুত ও বেশি হারে অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।
১৯৯৬ সালে নিবন্ধন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল এই যুবক। ২০০৫ সালে যুবকের প্রতারণামূলক কার্যক্রম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকলে তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে তখন যুবকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যুবকের ৩ লাখ ৪ হাজার গ্রাহকের পাওনা ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা কেউ ফেরত পাননি।
যুবকের পরে দেশে প্রলোভনের ব্যবসার ধরন পাল্টে দেয় বহুস্তর বিপণন বা এমএলএম ব্যবসা। বাংলাদেশে এই ব্যবসার গুরু শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত নারায়ণ দাস। ১৯৯৮ সালে তিনি বাংলাদেশে গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্ক (জিজিএন) নামের একটি এমএলএম কোম্পানি তৈরি করেন। পরে এই কোম্পানি ভেঙে নিউওয়ে প্রাইভেট বাংলাদেশ লি. এবং ডেসটিনি-২০০০ লি. নামে দুটি কোম্পানির জন্ম হয়। এরপরে জন্ম হয় ইউনিপে টু নামের আরেকটি এমএলএম কোম্পানির। ডেসটিনির ব্যবসার ধরন ছিল নানা পণ্য ও গাছ বিক্রি। আর ইউনিপে টু-এর অন্যতম ব্যবসা ছিল ভার্চ্যুয়াল সোনা বিক্রি। লাখ লাখ মানুষ প্রতারিত হওয়ার পরেই বন্ধ হয় জিজিএন, ইউনিপে টু বা ডেসটিনির ব্যবসা। অতি লোভে যাঁরা অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা কেউই আর সেই অর্থ ফেরত পাননি। এর দেখাদেখি সরকারি হিসাবেই তখন এ রকম ৬২টি এমএলএম কোম্পানি গড়ে উঠেছিল, তাদের সবার ব্যবসা ছিল প্রতারণার।
এমএলএম ব্যবসায় ভাটা পড়তেই আবির্ভাব মো. রাসেলের। ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রতারণার অন্যতম জনক তিনি। এমএলএম কোম্পানি শেষ, শুরু ই-কমার্স প্রতারণার। তাঁর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির জন্ম ২০১৮ সালে। সস্তায় মুঠোফোন আর মোটরসাইকেল কেনার লোভে এর গ্রাহক হয় লাখ লাখ মানুষ। তাঁর এই ব্যবসার ধরনে আকৃষ্ট হয়ে তৈরি হয় ইভ্যালির মতো আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। যেমন ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, দালাল, সিরাজগঞ্জশপ, ইত্যাদি। এসব কোম্পানির গ্রাহকেরা অর্থ আদৌ ফেরত পাবেন কি না, এ নিয়ে রয়েছে গভীর সন্দেহ।
শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত নারায়ণ দাস থেকে শুরু করে মো. রাসেল পর্যন্ত সবারই ব্যবসার মূল পুঁজি ছিল মানুষের সীমাহীন লোভ। শেয়ারবাজারের দুই কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তবে একশ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোভকে এককভাবে দায়ী করাটা হবে ভুল। এখানে লোভের অপর পিঠে আছে সুশাসনের অভাব। শেয়ারবাজারের দুই কেলেঙ্কারিই হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। দুই ক্ষেত্রেই ছিল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ও অযোগ্যতা। প্রভাবশালীদের চাপে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি তারা। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল যে শেয়ারবাজারের চাঙাভাব সরকারের প্রতি আস্থার প্রতীক। সুতরাং সরকারের নেতারা যখন আস্থার প্রতীক বলে ঘোষণা দেন, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ যদি নজর না দেয়, তাহলে বিনিয়োগ করার জন্য কেবল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মোটেই একতরফা দোষ দেওয়া যায় না। কেননা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতেই সরকারিভাবেই উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল।
ডেসটিনির সময়কার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। একদিকে তারা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে, অন্যদিকে নানা ধরনের সরকারি অনুষ্ঠানের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক হয়ে সম্পর্ক ঠিক রেখেছে। এই মডেলই অনুসরণ করেছে ইভ্যালি। নাটক, সিনেমা, জাতীয় ক্রিকেট দল, বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তির নানা অনুষ্ঠান—এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিল না যেখানে ইভ্যালির আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। আর বেছে বেছে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষক ছিল ইভ্যালি। ফলে দীর্ঘ সময় তারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও ২০২০ সালে একবার ইভ্যালিকে ধরার চেষ্টা হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করে রেখেছিল। কিন্তু এক মাস পরে ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার অর্থই হচ্ছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সাধারণ গ্রাহকেরা এটাকে একটি ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখেছেন। ফলে ইভ্যালিতে গ্রাহকের ভিড় আর কমেনি। এতে আরও বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের অর্থ নিয়ে অন্য খাতে খরচ করার অভ্যাস অব্যাহত রেখেছিলেন মো. রাসেল।
২০০৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারির তালিকা বেশ লম্বা। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কাহিনি, এবি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচার, ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার ধস, ই-কমার্স কেলেঙ্কারি—এসব ঘটনার জন্য কেবল মানুষের লোভকে দায়ী করা যাবে না। বরং এ জন্য মূলত দায়ী সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া, ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহ দেওয়া, নিয়ন্ত্রকদের অদক্ষতা এবং প্রভাবশালীদের দুর্নীতি।
দেশে আইনের শাসন আছে এবং প্রতারণা করলে পার পাওয়া যাবে না—এই কথা অনেকেই এখন বিশ্বাস করেন না। আবার একদল আছেন, আইন এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে বলে মনে করেন। ফলে তাদের পক্ষে মানুষের লোভকে ব্যবহার করা সহজ। সুতরাং এখানে লোভ নয়, দায়ী অন্য কিছু।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো—কোন পক্ষে যাবে?’ কবিতাটিতে আরেকটি লাইন ছিল, ‘প্রকৃতির ভেতরে তাকাও, দ্যাখো আলো এবং অন্ধকার দুটি পক্ষ’। সমস্যা এখানেই। আলো ও অন্ধকারের মধ্যে আলোকে বেছে নেওয়া সহজ। কিন্তু দুদিকেই যদি অন্ধকার থাকে?
তাহলে আপনি এখন কোন পক্ষে? মানুষের লোভ নাকি সরকারের দুর্বলতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতি?