লকার খোলা হবে। টান টান উত্তেজনা। যাতে আইনের কোনো ব্যত্যয় না হয়, সে জন্য একজন সরকারি লোকও আছেন। কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সাংবাদিকদেরও। তাঁরাও ভিড় করে আছেন। লকারের কম্বিনেশন জানলে অবশ্য সুবিধা হতো, ভাঙার আর দরকার পড়ত না। কারাগারে থাকা ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেল নাকি কম্বিনেশন জানাচ্ছেন না। সন্দেহ, লকার দুটিতে নিশ্চয়ই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ বা মহামূল্যবান কিছু রাখা আছে। তা না হলে মোহাম্মদ রাসেল জানাচ্ছেন না কেন?
প্রথম লকারটি ভাঙা শুরু হয় বেলা সোয়া তিনটার দিকে। লকারটি কাটতে গিয়ে একে একে নষ্ট হয় পাঁচটি ব্লেড। ছয় নম্বর ব্লেডে অবশেষে কাজ হয়। দ্বিতীয় লকারটি কাটতে অবশ্য আর ব্লেড নষ্ট হয়নি। ইভ্যালির কার্যালয়ে থাকা লকার ভেঙে তাহলে কী কী পাওয়া গেল?
আসুন কল্পনা করি–
আইনের ভাষায় জব্দ তালিকা বলতে একটি কথা আছে। আসুন, আমরা যা যা পাওয়া গেল, তা নিয়ে একটি জব্দ তালিকা বা সিজার লিস্ট তৈরি করে ফেলি।
১. পাঁচটি বই। যেমন—ক. ‘দ্য পঞ্জি বুক: আ লিগ্যাল রিসোর্স ফর আনর্যাভেলিং পঞ্জি স্কিমস’, লেখক ক্যাথি বাজোয়াইন ও স্টিভেন রোডস; খ. ‘পঞ্জি স্কিম: দ্য ট্রু স্টোরি অব আ ফিন্যান্সিয়াল লিজেন্ড: দ্য বার্নি ম্যাডফ পঞ্জি স্কিম’, লেখক মাইকেল জুকফ; গ. ‘ইজি মানি: দ্য গ্রেটেস্ট স্কিম এভার অ্যান্ড হাউ ইট ইজ সেট টু ডেস্ট্রয় দ্য গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম’, লেখক বিবেক কউল, ঘ. ‘অ্যানাটমি অব আ পঞ্জি: স্ক্যামস, পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’, লেখক কলিন ক্রস এবং ঙ. ‘ডেসটিনি: দ্রুত কোটিপতি হওয়ার উপায়’, লেখক মো. রফিকুল আমীন।
মন্তব্য: পঞ্জি স্কিম হচ্ছে মুনাফার ফাঁদে ফেলে প্রতারণার বেশ পুরোনো পদ্ধতি। মূলত, প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্যই এই স্কিম ব্যবহার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতারা বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য বইগুলো পড়তেন।
২. ফেসবুক লাইভের স্ক্রিনশট ও ৪,৩৩৮টি ফেসবুক আইডির তালিকা।
মন্তব্য: মোহাম্মদ রাসেল নিয়মিতভাবে ফেসবুকে লাইভ করতেন। সেখানে ইভ্যালির গুণগান করতেন, বড় বড় পরিকল্পনার কথা জানাতেন। কত কম অর্থে কত দামি পণ্য পাওয়া যায়, তার বর্ণনা দিতেন। গ্রাহকেরা সেসব কথাবার্তা শুনে ও দেখে পণ্য কেনার জন্য অর্থ পাঠাতেন।
তবে অর্থ পাঠালেও পণ্য পেতেন খুবই কমসংখ্যক গ্রাহক। যাঁরা পেতেন না, তাঁরা এসে অভিযোগ দিতেন ইভ্যালির ফেসবুক গ্রুপে। এ জন্য মাসিক ভিত্তিতে কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের নামে ছিল ৪,৩৩৮টি আইডি। অভিযোগ কেউ জানালেই এসব আইডির কাজ ছিল, তারা যে কত দ্রুত পণ্য পেয়েছে, তার ইতিহাস বর্ণনা করা। তাতেও যদি কাজ না হতো, তাহলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে লেগে পড়ত এসব আইডি। নাস্তানাবুদ করা হতো তাঁদের। সেই তালিকাই পাওয়া গেল লকারে।
৩. পাঁচটি ছবি ও পেপার কাটিং।
ক. ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর কালের কণ্ঠের অনলাইনে প্রকাশিত একটি সংবাদের কাটিং। সংবাদটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘ই-কমার্স মুভারস অ্যাওয়ার্ড পেল ইভ্যালি’। সংবাদটির শুরুটা এমন—‘ই-কমার্স মুভারস অ্যাওয়ার্ড পেল দেশীয় ই-কমার্সভিত্তিক মার্কেটপ্লেস ইভ্যালি ডট কম ডট বিডি। রোববার রাতে ই–কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইক্যাবের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১০০টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং ১২ ব্যক্তিকে ই–কমার্স মুভার্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। কোভিড-১৯ করোনা মহামারির সময়ে ই–কমার্সের মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এই সম্মাননা দেওয়া হয়।’
সংবাদে আরও বলা হয়, ‘রাজধানীর পূর্বাচলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। অনুষ্ঠানে নিজের অনুভূতি জানিয়ে ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বলেন, আজকের এই ইভ্যালির পেছনে আমার অনুপ্রেরণা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন আমাকে অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে। ইভ্যালি এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই চারটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। এর মধ্যে ইভ্যালির ৪০ লাখ নিবন্ধিত গ্রাহক রয়েছেন এবং ২৫ হাজার বিক্রেতা রয়েছেন। ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠান একসময় বাংলাদেশের আলিবাবা, আমাজন হবে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সংকটের সময়ে প্রকৃত নেতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।’
সংবাদটিতে জুনাইদ আহমেদের হাত থেকে শামীমা নাসরিনের পুরস্কার নেওয়ার একটি ছবিও যুক্ত আছে।
খ. যুগান্তরের একটি পেপার কাটিং। তারিখ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১। আর শিরোনাম হচ্ছে, ‘চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ড পেল ইভ্যালি’।
সংবাদের শুরুটা এ রকম—‘সেফ কিপার চ্যানেল আই মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ পেল দেশীয় ই-কমার্সভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইভ্যালি ডট কম ডট বিডি। ই-কমার্স ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই সম্মাননা পুরস্কার পায় ইভ্যালি। ২৬ ফেব্রুয়ারি চ্যানেল আই ভবনের চেতনা চত্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে পুরস্কার পদক তুলে দেওয়া হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার ও সনদপত্র তুলে দেন।’ এ ক্ষেত্রেও প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে মোহাম্মদ রাসেলের পুরস্কার নেওয়ার একটি ছবি সংযুক্ত আছে।
গ. বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডট কমে প্রকাশিত আরেকটি নিউজের কাটিং। তারিখ: ২৮ জুলাই, ২০২১। শিরোনাম হচ্ছে—‘ইভ্যালির বিনিয়োগ প্রযুক্তি খাতের জন্য মাইলফলক: পলক’। সংবাদটির শুরুটা এ রকম—‘ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস ইভ্যালির বিনিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি দেশের ই-কমার্স খাতসহ পুরো প্রযুক্তি খাতের জন্যই এক মাইলফলক বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বুধবার (২৮ জুলাই) বাংলানিউজের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় ইভ্যালির বিনিয়োগ পাওয়া নিয়ে নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ কথা বলেন পলক।’
(মন্তব্য-গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়েও ইভ্যালি তখন পণ্য সরবরাহ করতে পারছিল না। মোহাম্মদ রাসেল বলা শুরু করেছিলেন যে বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুন বিনিয়োগ খুঁজছেন তিনি। এ রকমই বলা হলো যে যমুনা গ্রুপ ইভ্যালিতে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। পরে অবশ্য যমুনা গ্রুপ পরিস্থিতি দেখে বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত জানায়।)
ঘ. দৈনিক যুগান্তরেরই ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আরেকটি পেপার কাটিং। শিরোনাম হচ্ছে—‘নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের স্পনসর ইভ্যালি’।
ঙ. ইত্তেফাক অনলাইনে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদের কাটিং। প্রকাশ—২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি। শিরোনাম হচ্ছে—‘ইভ্যালির পৃষ্ঠপোষকতায় র্যাবের চলচ্চিত্র ‘অপারেশন সুন্দরবন’। আর সংবাদটি এ রকম, ‘দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হতে যাচ্ছে চলচ্চিত্র “অপারেশন সুন্দরবন”। র্যাব ওয়েলফেয়ার কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রযোজনায় দেশি-বিদেশি কলাকুশলী এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ভিএফএক্সের ছোঁয়ায় নির্মাণ করা হবে চলচ্চিত্রটি।
‘সম্প্রতি র্যাব সদর দপ্তরে ইভ্যালির পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতার চেক তুলে দেওয়া হয়। ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের নিকট চেকটি হস্তান্তর করেন। এ সময় ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলসহ ইভ্যালি এবং র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।’
৪. একটি পেপার কাটিং ও একটি বিশেষ নথি। পেপার কাটিংটি প্রথম আলোর। প্রকাশ-২০২০ সালের ২৪ আগস্ট। শিরোনাম—‘ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ই-ভ্যালি’।
মন্তব্য: লকারে এটি বেশ যত্ন করে রাখা। ধারণা করা হচ্ছে, সঙ্গে থাকা বিশেষ নথিটির জন্যই সংবাদটির একটি অনুলিপি বা কপি আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ নথিটি খরচের।
প্রথম আলোতে ইভ্যালি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিষ্ঠানটি নিয়মের মধ্যে না থেকে আরও বেশি অনিয়ম করা শুরু করে। তবে এ জন্য এক মাস অপেক্ষা করতে হয়। কেননা প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশের পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির দেওয়া প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ২৭ আগস্ট ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেলের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
তবে এক মাস পর খুলে দেওয়া হয় ইভ্যালির সব ব্যাংক হিসাব। ব্যাংক হিসাব খোলার দিনটি স্মরণীয় করতে মোহাম্মদ রাসেল কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। নতুন উদ্যমে ফেসবুকে লাইভে আসেন। গ্রাহকেরাও আশ্বস্ত হয়ে বিপুল উৎসাহে কম দামে পণ্য কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে আয়ও হয় বেশ। তবে এ জন্য নানা জায়গায় খরচও করতে হয়েছে বেশ। নথিটি সেই খরচের হিসাবের। প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন, তিনজন তারকা, কয়েকজন সাংবাদিক—কে নেই সেই তালিকায়!
এই যুগে যাঁরা ভেবেছিলেন কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ লকারে রেখে দেবেন মোহাম্মদ রাসেল, তাঁদের জন্য সমবেদনা। তবে চার হাজার টাকার ব্লেড ভেঙে লকারে মাত্র ২ হাজার ৫৩০ টাকা পাওয়ার সংবাদে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যেসব বই, ছবি ও পেপার কাটিং পাওয়া গেল, সেগুলোর গুরুত্ব কম কিসে?