এখন বালিশের নিচে রাখা কালোটাকাও সাদা করা যায়। কালোটাকার মালিকেরা শাস্তি তো পাচ্ছেনই না, বরং স্বীকৃতি পাওয়া শুরু করেছেন।
কালোটাকার দুই রং—কালো ও সাদা। অর্থনীতিশাস্ত্রে কালোটাকাকে বলা হয় অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি বা ‘ইনফরমাল ইকোনমি’। আবার অনেকে একে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি’, ‘হিডেন ইকোনমি’, ‘শ্যাডো ইকোনমি’ বা ‘আনরেকর্ডেড ইকোনমি’ বলে থাকে। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী কিথ হার্ট প্রথম ১৯৭১ সালে ঘানার ওপর এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে ইনফরমাল ইকোনমি কথাটা ব্যবহার করেন। সেই থেকে শুরু।
সাধারণত সব ধরনের অনিবন্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি বলা হয়। অনিবন্ধিত বলতে বৈধ ও অবৈধ, সবকিছুই। ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান, কর ফাঁকি, চাঁদাবাজিসহ যেকোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে আয়ই কালোটাকা। আবার যেসব কর্মকাণ্ড করের আওতায় থাকলেও তা মানা হয় না, তাকেও কালো অর্থনীতি বলে।
অনেকে অবশ্য কালোটাকার মর্যাদা নিয়ে খুবই সচেতন। তাঁরা একে কালোটাকা না বলে অপ্রদর্শিত অর্থ বলার চেষ্টা করেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, কর না দেওয়ার কারণে অনেক বৈধ আয় অবৈধ হয়ে যায়। সুতরাং এই প্রায় নির্দোষ টাকা আসলে কালো নয়, অপ্রদর্শিত। বিশেষ করে সরকার যখন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়, তখন নাগরিকদের কাছে মুখরক্ষার জন্য তাকে অপ্রদর্শিত অর্থ নাম দিয়ে থাকে। সরকার কখনোই অর্থ বৈধ পথে আয় না অবৈধ পথে, তা খুঁজে দেখে না।
তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসে নিতাইচরণ বলেছিল, ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে’। এ যুগে অবশ্য কালো চুলের উদাহরণ না দিয়ে কালোটাকার উদাহরণ দেওয়া যায়। কারণ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সেই কবেই লিখে গেছেন, সবাই টাকার বশ,/ টাকাতেই যত রস।/ টাকা যার তার যশ,/ ব্যাপ্ত হয় দিক দশ। কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরের সেই কথা নিশ্চয়ই মনে আছে, ‘মন! মন আবার কি? টাকা ছাড়া মন কি? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই। টাঁকশালে আমাদের মন ভাঙে গড়ে।’
সুতরাং কালোটাকার মালিকের সংখ্যা যে বাড়ছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তিন সঙ্গী গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘টাকা যে মানুষ জমিয়েছে অনেক পাপ জমিয়েছে সে তার সঙ্গে।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা মনে না রাখলেই তো হয়।
আদি থেকেই টাকা দুই রঙের। দুর্নীতিও যেমন আদি। সুতরাং কালোটাকাও আছে শুরু থেকে। তাহলে এই অঞ্চলে কালোটাকা শুরু কখন থেকে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত লিখেছেন, ‘কালো টাকার যে সমস্যা এখন বিরাট আকার ধারণ করেছে, তার সূত্রপাত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহের অপ্রাচুর্যে। এই বিপর্যয় এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দেখা গেল যে, এই অঞ্চলে কাঁচা টাকার ছড়াছড়ি। আমেরিকান ও ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। যুদ্ধের কন্ট্রাক্ট-এ এবং মজুদদারিতে লাভের অঙ্ক বেড়ে চলল। আমাদের দেশে কালোবাজারের সমান্তরাল আর্থিক পরিস্থিতির জন্ম তখনই।’
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশেও সমান্তরাল অর্থনীতির জন্ম যুদ্ধের পর থেকেই। এরপর থেকে নানা উপায়ে ক্রমশ কালোটাকা বেড়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক সাদরেল রেজার। ‘ব্ল্যাক ইকোনমি ইন বাংলাদেশ: সাম প্রিলিমিনারি অবজারভেশন’ গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতায় নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ড কীভাবে কালো আয়ের পথে সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
কালোটাকার মালিকেরা তাঁদের অবৈধ উপার্জন নিয়ে কী করেন? অল্প একটি অংশ নানা খাতে বিনিয়োগ করেন, আরেক অংশ অন্য দেশে পাচার করেন, অনেকে অর্থ বেনামেও রাখেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে অর্থ রেখে সর্বদা আতঙ্কের মধ্যে থাকেন, আরেকটি পক্ষ টাকা রাখেন বালিশের ভেতরে, চালের ড্রামে।
অবশ্য সব সরকারই এসব কালোটাকার নাগরিকদের কষ্ট লাঘবে খুবই তৎপর ও আন্তরিক। আর এ কারণেই টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দেওয়া হয় বারবার। সময় যত গেছে, এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা মনে হয় আরও বেড়েছে।
যেমন দেশে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে। তখন এর নাম ছিল ‘কর-অনারোপিত আয়’। এরপরে যতবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, প্রতিবারই সুযোগ না নিলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন কোনো উদাহরণ নেই। মানুষ ভয় পেয়েছিল একবারই, ২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে, আগে শর্ত সাপেক্ষে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতো। এখন তো তা–ও নেই।
ঋণখেলাপি ও কালোটাকার মালিকদের প্রতি বর্তমান সরকার শুরু থেকেই সদয়। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আরেকটু বেশি সদয়। গত দুই বছরে ঋণখেলাপিদের দেওয়া হয়েছে নানা ধরনের সুবিধা। এমনিভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকার মালিকদের জন্য দেওয়া আছে ঢালাও সুবিধা।
যেমন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’
এ ছাড়া বাজেটে আরও বলা আছে, একই সময় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাগণ পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করলে, আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না।
‘বনের রাজা’ ওসমান গনির কথা মনে আছে? সেই যে সামরিক বাহিনী–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় বালিশের ভেতরে থাকা ১ কোটি ৬ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। এখনকার ওসমান গনিদের আর কোনো চিন্তা নেই। এখন বালিশের নিচে রাখা অর্থও সাদা করা যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম ব্যাংকে বা নিজের কাছে রাখা নগদ অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আগে সরকারের যতটুকু চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন তা–ও আর রইল না।
প্রায়ই সমালোচনা করা হয়, কালোটাকার মালিকেরা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক, তাঁদের ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু কালোটাকার মালিকদের যে অর্থনীতিতে বড় অবদান আছে, এ কথা স্বীকারই করা হয় না। বলা যায়, প্রথমবারের মতো সরকার কালোটাকার মালিকদের স্বীকৃতি দিল।
৪ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে ১০ হাজার ২২০ কোটি কালোটাকা সাদা হয়েছে। আর এই সুযোগ নিয়েছেন ৭ হাজার ৬৫০ জন। তাঁদের মধ্যে কেবল ডিসেম্বর মাসেই ৪ হাজার ২৯২ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এভাবে কালোটাকা সাদা করাকে ‘অভূতপূর্ব’ হিসেবে অভিহিত করে এনবিআর বলেছে, ‘অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে চলতি অর্থবছরে সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে বিশেষ সুযোগ দেয়। এ সুযোগে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন সম্মানিত করদাতারা।’
লক্ষ করুন, যাঁরা কালোটাকার মালিক, অন্য সব সৎ করদাতার মতো যাঁরা নিয়মিত আয়কর দেননি, তাঁরা হলেন এনবিআরের ভাষায় সম্মানিত করদাতা। আবার এর এক দিন পরেই সিঙ্গাপুরে বসে অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘৬ মাসে যে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি কালোটাকা সাদা হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলো এসেছে বলেই অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
করোনার সময় অর্থনীতি বিপর্যস্ত। উদ্যোক্তা, শ্রমিক, কৃষক ও প্রবাসীরাসহ সাধারণ মানুষ টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাঁদের সবার ভূমিকা ও অবদান অর্থনীতি উত্তরণের পথে। কিন্তু এখন জানা গেল, আসলে কালোটাকা ফ্ল্যাট বা শেয়ারবাজার ঢুকছে বলেই অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য এসেছে।
সুতরাং অর্থনীতিতে অবদান রাখার, চাঞ্চল্য সৃষ্টি করার এবং সম্মানিত করদাতা হওয়ার এই সুযোগ কেউ হেলায় হারাবেন না। আসুন, কালোটাকা উপার্জন করি, আর ঢালাও সুযোগ পেয়ে সাদা করি। আর যাঁরা পাচার করেন, তাঁদের জন্য তো রয়েছেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা কানাডার নিরাপদ জীবন!